বাঘের বিপদ বাড়ছে সুন্দরবনে:বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার পথে পিছিয়ে বাংলাদেশ

ভারত, নেপাল, ভুটান ও থাইল্যান্ডের সাফল্য

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: সুন্দরবনে বিপদ বাড়ছে বাঘের। রোবাবার ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের চুনকুড়ি রাজাখালী খালের পাশ থেকে এক বাঘের মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়। গত দেড় বছরে দেশে হঠাৎ করে বাঘের মৃত্যুু বেড়ে গেছে। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে বছরে বাঘের মৃত্যুর ঘটনা ছিল একটি করে। মানুষের পিটুনির শিকার হয়ে এবং চোরা শিকারিদের অস্ত্রের আঘাতে বেশির ভাগ বাঘের মৃত্যুু হয়। গত দেড় বছরে বাঘ মারা গেছে তিনটি। গত বছর দুটি ও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে একটি ও শেষের ৪ মাসে আরো একটি বাঘ মারা যায়। কেবল বাঘ হত্যা নয়, সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনাও গত দেড় বছরে বেড়ে গেছে। গত দেড় বছরে মোট পাঁচবার আগুন লেগেছে। এক দশক আগে দুই বা তিন বছরে একটি ঘটনা ঘটত। বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার পথে পিছিয়ে বাংলাদেশ। ভারত, নেপাল, ভুটান ও থাইল্যান্ডের সাফল্য।

বাংলাদেশে ২০০৪ সালের পায়ের ছাপ গুনে করা জরিপে ৪৪০টি বাঘ থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ক্যামেরা ফাঁদের মাধ্যমে করা জরিপে বাঘের সংখ্যা বেরিয়ে আসে ১০৬টি। এরপর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আরেকটি শুমারি করে জানায়, বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। ২০২২ সালে বাংলাদেশের আরেকটি জরিপ করার কথা রয়েছে।

২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১৩টি রাষ্ট্র নিজ নিজ দেশে বাঘের সংখ্যা এক যুগের মধ্যে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়েছিল। এর মধ্যে নেপাল বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। ভারত ও ভুটানও দ্বিগুণের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা সামান্য বাড়লেও সেই লক্ষ্য থেকে দূরে আছে। সম্প্রতি বাঘের মৃত্যুু ও হত্যা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ যতটুকু এগিয়েছিল, সেখান থেকেও আবার পিছিয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রথম সম্মেলনে প্রতিটি দেশ প্রতি দুই বছরে একবার করে বাঘশুমারি করবে বলে অঙ্গীকার করেছিল। দেশগুলো একটি কর্মপরিকল্পনা করে বাঘ রক্ষায় উদ্যোগ নেবে বলেও জানিয়েছিল। বাংলাদেশ ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে বাঘ রক্ষায় একটি প্রকল্প গ্রহণ করে, যা ২০১৯ সালে শেষ হয়। এরপর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বাঘ রক্ষায় পদক্ষেপ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, বাঘ রক্ষার জন্য বন বিভাগকে যেভাবে প্রস্তুত করা দরকার, তা এখনো হয়নি। আর ২০১৫ সালের শুমারিতে বাঘের সংখ্যা ১০৬টি আর ২০১৮ সালে ১১৪টি বলা হলেও এর মাধ্যমে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলা যাবে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা দূরে থাক, আদৌ সুন্দরবনে কোনোমতে টিকে থাকা বাঘগুলো শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না, সেই প্রশ্ন করতে হবে। সরকারের উচিত নিজ উদ্যোগে বাঘের সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া।’

এর মধ্যে ১০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পটি অনুমোদন হলেও এর অর্থ বরাদ্দ হয়নি। আর ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত বাঘ সুরক্ষা প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের সভায় বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে, আয়বর্ধক কোনো প্রকল্প ছাড়া নতুন কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে না।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে ভারতের দিলি¬তে অনুষ্ঠিত বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের বাঘ সুরক্ষা কার্যক্রমের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে ৩ হাজার ৮৯০টি বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে ভারত বাঘের সংখ্যা দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২২৬টি করেছে। নেপাল ১০০টি থেকে বাড়িয়ে ১৯৮টি, ভুটান ৫০টি থেকে ১০৩টি করেছে। থাইল্যান্ড বাঘের সংখ্যা ৯০টি থেকে ১৮৯টি করেছে। আর চীনে বাঘের সংখ্যা সাতটি, লাওসে দুটি, ভিয়েতনামে পাঁচটিতে নেমে এসেছে। আর কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

সুন্দরবনের দোবেকী টহল ক্যাম্পের বনকর্মী রিপন জানান, বনে বাঘ, হরিণ এবং শূকরের সংখ্যাও আশানুরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাঘের প্রধান শিকার শূকর এ কথা উলে¬খ করে তিনি বলেন, দোবেকীর মিষ্টি পানির পুকুরপাড়ে মাস দুয়েক আগে একটি বাঘ একটি শূকর ধরে খেয়ে যায়।

সরকার প্রধান সংসদকে জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার সুন্দরবন ও জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় সবসময় আন্তরিক ও বদ্ধপরিকর, ‘দেশের উন্নয়নে যে পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন সুন্দরবন এবং এর জীব-বৈচিত্র্য যেন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। সুন্দরবনের আয়তন বাড়ানোর জন্য সরকার কৃত্রিম ম্যানগ্রোভবন সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে এর বিস্তৃত ঘটানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সুন্দরবনের বৃক্ষাদি এবং বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য তথা বন অপরাধ দমনের জন্য স্মার্ট পেট্রোলিংসহ নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

Please follow and like us:

Check Also

২৮শে এপ্রিল খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবারেও ক্লাসের পরিকল্পনা

আগামী ২৮শে এপ্রিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সব রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।