শাহনেওয়াজ খান সারেং আগেই বলে রেখেছিলেন হরিণ দেখতে চাইলে খুব ভোরে উঠতে হবে। ভাগ্যে থাকলে মিলতে পারে বাঘের দেখাও। সবাই মিলে সময়মতো বের হওয়াই এখন চ্যালেঞ্জ। আমাদের দুজনের মতো লঞ্চের বাকি পর্যটকরাও আলাদাভাবে এসেছেন। শুধু কয়েকজন এসেছেন একটি ট্রাভেল গ্রুপের সাথে। ছন্নছাড়া এই পর্যটকদের একই সময়ে নিয়ে বের হওয়াও একটা কঠিন কাজ। তবে ভরসা একটাই—দু-একজন ছাড়া বাকি সব পর্যটকই নামাজি। ফজরের সময় প্রায় সব সদস্যই ঘুম থেকে জাগবে; তারপরই ছুট। এখন বাঘ মামার নজর এদিকে থাকলে হয়!
ভোর ৬টায় লঞ্চের সাথে বাঁধা ইঞ্জিনবোটে উঠার কথা। প্রায় সাড়ে ৫টায়ই সব পর্যটক প্রস্তুত। সারেং অবাক, পর্যটক প্রস্তুত থাকলেও তারা প্রস্তুত নন! তিনি বলেই ফেললেন, প্রায় ৩০ বছরের নৌ-চালনার জীবনে তিনি বিদেশিদের ছাড়া কোনো দেশি পর্যটক দলকে সকালে যাত্রার সময় ঠিক রাখতে দেখেননি। কটকা অভয়ারণ্যের কাছেই লঞ্চ নোঙ্গর করা ছিল। ইঞ্জিনবোটে চড়ে দু-এক মিনিটেই চলে গেলাম কটকা ফরেস্ট রেঞ্জে। ঘাট পার হতেই বানরের দেখা। রাস্তার মধ্যে এদিক-সেদিক ছুটছে। কোনোটা লাফাচ্ছে ডাল থেকে ডালে। একটু সামনে পেরুতেই কাঠের ট্রেইল। শুধু সৌন্দর্যবর্ধন নয়, জোয়ারের পানি উঠে আসার পরও জন্য পর্যটকরা যেন হাঁটতে পারেন এজন্যই এ ব্যবস্থা। হাঁটার শুরুতেই হঠাৎ বাম দিক থেকে বিকট আওয়াজ আর খচখচানির শব্দ। মুহূর্তেই দুটি বন্য শূকরকে তেড়ে আসতে দেখা গেল। তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় ব্যস্ত। যুদ্ধরত অবস্থায় ট্রেইলের নিচ দিয়ে দৌড়ে গেল। ভয়ে সবাই থমকে দাঁড়াই। স্পষ্ট হলো, উঁচু ট্রেইল তৈরির আরও কারণ আছে।
ট্রেইল থেকে নেমে বনের কাঁদাময় পথে জুতা হাতে নিয়ে শুরু হলো নতুন যাত্রা। উদ্দেশ্য—টাইগার টিলা। বাঘের খোঁজে যাওয়ার আগেই পেলাম হরিণের খোঁজ। কয়েকটি চিত্রা হরিণ পাতা খেয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেখে খানিকটা দূরে চলে গেল। তাদের পিছু না নিয়ে আমরা হাঁটছি সামনের পথে। দলে আছি দশ-বারোজন। বাকিরা কাঁদাময় পথে গহীন বনের ভেতর বাঘের ডেরায় যাওয়ার সাহস পায়নি। দলের শুরুতে বন্দুক হাতে রয়েছেন বনবিভাগের কর্মী। তিনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। খানিক বাদেই পৌঁছে গেলাম টাইগার টিলায়। বনের মাঝে কিছুটা উঁচু জায়গা। কথিত আছে, জোয়ারের সময় এখানে আশ্রয় নেয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এজন্যই জায়গাটির নাম হয়েছে টাইগার টিলা। ইতিহাস অনুযায়ী, কয়েকশ’ বছর আগে এখানে ছিল লবণ কারখানা। এখানে উৎপাদিত উন্নত মানের লবণ যেত ইউরোপে। সেসব এখন অতীত। এককালের সমৃদ্ধ নগর এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন! যেখানে বাস করত মানবসমাজের রাজা-জমিদাররা; সেখানে এখন বনের রাজা বাঘের বাস।
টাইগার টিলা থেকে আরেকটু সামনে যেতেই পড়লাম খালের সামনে। স্থানীয়ভাবে পরিচিত বয়ার খাল নামে। আমাদের দেখে বড় আকারের এক বনমোরগ উড়ে চলে গেল খালের ওপারে। খালের পাশ দিয়ে মোড় নিলাম ফিরতি পথে। সামনে যেতেই হরিণের পালের খোঁজ পেলাম। হেঁটে হেঁটে পাতা খাচ্ছে। বেশ কয়েকটি গাছ থেকে পাতাসহ ডাল ভেঙে আনলো কয়েকজন। সেগুলো দিতেই হরিণগুলো খেতে দৌড়ে আসলো। সুন্দরবনের ভেতর একেবারে এত কাছে হরিণের পালকে পেয়ে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। খানিকটা কাছ থেকেই ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম। তবে একেবারে কাছে যাওয়া গেল না। অতি সাবধানী হরিণ সবসময় নজর রাখছিল। বেশি কাছে যেতে চাইলেই দে ছুট।
বনের আরেক প্রান্তে সুন্দর এক সৈকত। কটকা সৈকত নামে পরিচিত এই সৈকত ধরেই যাওয়া যায় জামতলা সৈকতে। মূলত, একই সৈকত কিন্তু প্রচুর জামগাছ থাকায় ওই অংশ পরিচিত জামতলা সৈকত নামে। চোরাবালি রয়েছে আশঙ্কায় কটকা সৈকতের একটি পাশে পর্যটকদের যেতে অনুৎসাহিত করা হয়। কাঠের ট্রেইলটা শেষ হয়েছে সৈকতে গিয়ে। এখন অবশ্য ট্রেইল ধরে সৈকতে পৌঁছানো যায় না। ট্রেইলের শেষ অংশের অনেকখানিই ভাঙা। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এই অবস্থা। বালুকাময় সৈকতে এখনও পড়ে রয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ধ্বংসলীলার চিহ্ন। জায়গায় জায়গায় উপরে রয়েছে গাছ। ফেরার পথে আরও পর্যটককে সেখানে যেতে দেখলাম। দু-একজন অতি উৎসাহী নারী বানরের দৌড়ানিও খেলেন।
ইঞ্জিনবোটে চড়ে এবার বনের ভেতরে এক খালে ঢুকলাম। বনের নীরবতা বজায় রাখতে ও বন্যপ্রাণী দেখতে সবাই নিশ্চুপ রয়েছি। ইঞ্জিনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দাঁড় বেয়ে চলছে নৌকা। পথে কয়েক প্রজাতির পাখি ও বানরের দেখা মিললো। শোনা যায়, এই খাল পাড়ি দেয় বাঘ। খাল ঘুরে এবার রওনা কচিখালীর পথে। আগেই অনুমতি নেওয়া ছিল। তাই ফরেস্ট রেঞ্জে দেরি হলো না। সবাই মিলে ছুটলাম কচিখালী সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে। বনের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। বারবার সাবধান করছেন বনকর্মী। বনের ভেতর নির্দিষ্ট পথ ধরে হাঁটতে বলছেন। কারণ, এই অঞ্চলে বাঘের আনাগোনো রয়েছে। বেশ দূরের পথ, তাই কিছুটা বিশ্রাম নিতে হলো। বনের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছার আগেই সমুদ্রের গর্জন। সঙ্গে বনের ভেতর বালুকাময় ভূমি ও পানির ছাপ জানান দিচ্ছিল বঙ্গোপসাগরের।
একপাশে সুন্দরবন আরেকপাশে বঙ্গোপসাগর—বাংলাদেশের দুই অপার সৌন্দর্য ও গর্ব যেন এখানে মিলেমিশে একাকার। দুই মহীরুহের মিলনস্থলে খানিক সময় কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম সৈকত ধরেই এগিয়ে যাব কচিখালী ফরেস্ট রেঞ্জের কাছে। বনকর্মী জানালেন, এই পথে হাঁটতে হবে বহুদূর। রোমাঞ্চপ্রিয় মনে কষ্টের কোনো জায়গা আছে? সৈকত ধরেই হাঁটতে লাগলাম। খানিক দূরে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন বনকর্মী। বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। একটা নয় একাধিক। আমরাও দৌড়ে গেলাম। কোনো ছাপ বড়, কোনোটা ছোট। বনকর্মী জানালেন, হয়ত মাঝরাত বা ভোরে বাচ্চাসহ এখানে এসেছিল কোনো বাঘ বা বাঘিনী। বাচ্চাসহ? তার মানে বাঘের বংশ বৃদ্ধির আভাস।
সাগরে এখনও ভাটা চলছে। সৈকতে জায়গায় জায়গায় আটকে আছে পানি। তেমনি এক জায়গায় মাছের আনাগোনা ছোখে পড়ল। সবাই মিলে মাছ ধরা শুরু করলাম। প্রায় ২০-২৫টা মাছ ধরেও ফেললাম। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সুন্দরবনের পাড়ে সৈকতে মাছ ধরার বিচিত্র স্মৃতি হৃদয়ে থাকবে আজীবন। বনের ভেতর দিয়ে ফেরার পথে সেখানে বসবাসরত কিছু লোকের সাথে দেখা হলো। বেশ কয়েকটি ঘর তুলে তারা এখানে থাকে। সবাই বনে থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের স্থায়ী আবাস মূলত সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ে। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে এখানে তারা অস্থায়ী ঠিকানা গড়ে জীবিকা নির্বাহ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। মধু সংগ্রহ, মাছ ধরা, চাষাবাদ তাদের কাজ।
বিকালে গেলাম ডিমের চর। চরটি ডিম্বাকৃতির হওয়ায় এই নাম। চরে নামতেই অপূর্ব এক দৃশ্য—সাগর-নদীর মোহনায় ডুবছে সূর্য। লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। সৈকতে শুরু করলাম ফুটবল খেলা। জীবনে আর কখনও এমন স্থানে ফুটবল খেলার সুযোগ মিলবে? কেউই এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না। কেউ কেউ গোসলও সেরে নিলো। হালকা ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকায় আর দুপুরে গোসল করায় দ্বিতীয়বার গোসলের সাহস করলাম না।
লঞ্চে দ্বিতীয় রাত কাটলো কটকা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের কাছে। সকালে শুরু হলো করমজল প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা। যাত্রাপথে শ্যালা নদীর তীরে হরিণের দেখা মিললো। চোখ খুঁজে ফিরছে বাঘকেও। কিন্তু না, দেখা নেই। রৌদ্র পড়তেই নজরদারি শুরু করলাম নদীর তীরে। কুমিরের রোদ পোহানোর এখনই সময়। কিছু দূর যেতেই একটি কুমিরকে শুয়ে রোদ পোহাতে দেখা গেল। লঞ্চের গতি কমিয়ে কুমিরের অনেকটা কাছে যাওয়ার চেষ্টা চললো। খানিকটা কাছে যেতেই নদীতে নেমে ডুব দিলো কুমিরটি। আরেকটু এগোতেই নদীর আরেকপাশে দেখা মিললো আরেক কুমিরের। বেশ আরামে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। লঞ্চ দেখেও পাত্তা নেই। তার পাশ দিয়েই এগোলাম। স্রোতস্বিনী পশুর নদ হয়ে পৌঁছলাম করমজল। আগে পশুর নদে প্রচুর গাঙ্গেয় ডলফিনকে লাফালাফি করতে দেখেছি। এবার অবশ্য তেমনটা চোখে পড়ল না।
করমজল মসজিদের জুমার নামাজ পড়ার পর কৃত্রিমভাবে প্রজনন করা লোনাপানির কুমির, বিলুপ্ত প্রজাতির কচ্ছপ (বাটাগুড় বাল্কা), চিত্রা হরিণ দেখলাম। পর্যটনস্পটে হাঁটার সময় দেখা মিললো বানরের। মানুষের দেওয়া চিপস, বিস্কুট, কদবেল খাচ্ছে। লাফিয়ে চলছে ডাল থেকে ডালে। কখনও পর্যটকদেরও টেনে ধরছে। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে সুন্দরবনের একাংশ দেখে নিলাম এক পলকে। এবার মোংলা হয়ে ফেরার পালা। সুন্দরবন ছেড়ে ফিরতে হবে—এই ভাবনা এতক্ষণ মাথায় আসেনি। এখন সত্যিই বিষয়টি মন খারাপ করে দিচ্ছে। এত দ্রুত চলে গেল সময়! ইশ্ আরও কয়েকদিন যদি থাকা যেত—এসব চিন্তা করতে করতেই চলে এলাম মোংলা ঘাট। বন্ধু তানভীরের সাথে দেখা হলো না। বিষণ্ন মনে শেষবারের মতো তাকালাম সুন্দরবনের দিকে। আবার আসব, যাব বাঘের ডেরায়—ভাবতে ভাবতে বিদায় জানালাম শ্বাসমূলীয় বনকে। (শেষ)
লেখক : সাবেক গণমাধ্যমকর্মী