চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছিল। সেই চাকায় বাড়তি গতি দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। আমদানি-রফতানি বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। অর্থনীতির যাবতীয় সূচকও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। উদ্যোক্তাদের অনেকেই দীর্ঘ বিরতির পর ছুটতে শুরু করেছেন ব্যাংকের দিকে। ব্যবসার সম্প্রসারণ ও নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য ব্যাংকের কাছে ঋণও চাচ্ছেন তারা। যে কারণে সুখবর অপেক্ষা করছে আমানতকারীদের জন্যও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দীর্ঘদিন পর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে। গত ১৩ মাসে সর্বোচ্চ ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে গত অক্টোবরে। এতে করোনার কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে যে মন্দা ছিল, সেটা অনেকটাই কেটেছে।
এদিকে ঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমানতকারীদের জন্য সুসংবাদ আসছে। বাড়তে শুরু করেছে সুদের হার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে মেয়াদি আমানতে সুদ বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। একইভাবে সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে সুদ হার বেড়েছে। ঋণের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে তাতে আমানতের সুদের হার আরও বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোর সংগৃহীত আমানতের গড় সুদহার সামান্য বেড়ে ৪ দশমিক ০৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। গত আগস্টে আমানতের গড় সুদহার ছিল সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ০৫ শতাংশ।
সরকারি ও বেসরকারি বেশ কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, অনেকেই আগের নেওয়া ঋণ নবায়ন করছেন। অনেকেই নতুন প্রকল্পে ঋণের আবেদন করেছেন।
ব্যাংকগুলোও আগের চেয়ে বেশি ঋণ দিচ্ছে। তবে ঋণের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে আমদানি ব্যয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যা গত ১৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছরের অক্টোবরে ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮.৬১ শতাংশ।
অক্টোবরের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি বেড়ে হয়েছে ১২ লাখ ১৯ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে ছিল ১২ লাখ ১০ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। আগস্টে ছিল ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বরে সরকারি খাতে ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৭৭ শতাংশ। গত মে’তে প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ৭.৫৫ শতাংশ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।
করোনার প্রথম ঢেউয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৮.৬১ শতাংশে নেমে আসে। এরপর সরকারের প্রণোদনার ঋণে ভর করে ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৯.২০ শতাংশ হয়। আগস্টে তা বেড়ে ৯.৩৬ শতাংশে এবং সেপ্টেম্বরে ৯.৪৮ শতাংশে ওঠে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই প্রবৃদ্ধি কমে মে’তে ৮ শতাংশের নিচে নেমে যায়।
এদিকে গত অর্থবছরের শেষ মাস থেকে টানা বাড়ছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি। জুনে বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি হয় ৮.৩৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে ৮.৩৮ শতাংশ, আগস্টে ৮.৪২ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৮.৭৭ শতাংশ এবং অক্টোবরে উঠেছে ৯.৪৪ শতাংশে।
ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন প্রকল্প ছাড়াও স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তারা তাদের কার্যক্রম চালু করেছেন। তারাও ব্যাংক-ঋণের জন্য আবেদন করছেন।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, অর্থনীতি সচল হওয়ার ইঙ্গিত এটি। আগামী দিনগুলোতে ঋণের প্রবৃদ্ধি তীব্রভাবে বাড়বে। কারণ উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে মরিয়া হয়ে তহবিল খুঁজছেন। তাদের চাহিদার কারণে অচিরেই ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় চাপ তৈরি হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে ভোক্তা ঋণও বাড়তে শুরু করেছে। করোনার সময়ে বাড়ি-গাড়ি কেনা ও ব্যক্তিগত ঋণ যেভাবে কমে এসেছিল, সেটাও বাড়ছে।
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি খাতে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে গত অর্থবছরে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে আসে।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নতুন প্রকল্পের জন্য ঋণের আবেদন আসছে। অন্যদিকে প্রণোদনা তহবিল নেওয়া কিছু ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। যে কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ নবায়ন শুরু করেছে। এতেও ঋণ বাড়ছে।’