দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে উপকূলের কৃষি

আবু সাইদ বিশ্বাস: উপকূলীয় অঞ্চল ফিরে: সবজি উৎপাদনে উত্তরবঙ্গকে পিছে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল। উত্তরবঙ্গকে এক সময়ে শস্যগোলা ধরা হলেও বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিপর্যস্থ। পানি সংকট, খরা ও শৈত্যপ্রবাহ এখন শস্যহানির এক অনিবার্য নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এক চমৎকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিতে এখন শুধুই জয়জয়কারের ধ্বনি। অনেক কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে । সাবলম্বী হচ্ছে অনেকে। দেশের অর্থনীতির চাকা নিত্য সচল রাখছে উপকূলের কৃষি। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে অনেক জমির পাশে এখন ট্রাকে করে শাকসবজি দেশের অন্যত্র যাচ্ছে। গ্রীষ্মকালটাই এখানে শাকসবজি চাষের সম্ভাবনাময় মৌসুম। সেচ সংকট ও লবণাক্ততাসহ নানা প্রতিকূলতার লড়াই করে এখানকার সবজি চাষিরা শীতকালেও সবজি চাষের ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করেছে।
দেশের পাঁচ ভাগের একভাগ মানুষ বাস করে উপকূলীয় ১৪টি জেলায়। এ অঞ্চলের মানুষ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দারিদ্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিবেচনায় সুবিধাবঞ্চিত। দেশের মোট আবাদি জমির ৩০ শতাংশ জমি রয়েছে এ অঞ্চলে । উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন প্রায় দেড় থেকে দ্বিগুণ করা সম্ভব। উপকূলীয় অঞ্চলের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে শুধু ফসল নয়, কৃষির বৈচিত্র্যকরণ করে মাঠ ফসল, উদ্যান ফসল, অর্থকরী ফসল, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ প্রভৃৃতির উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা উন্নয়ন করে একটি সুসমন্বিত ও সুসংহত টেকসই কৃষি উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া যাওয়ার জোর দাবী উঠেছে।
আয়তনে ছোট এবং বেশ ঘনবসতিপূর্ণ হলেও বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরে সীমিত সাধ্য নিয়েই যে ১৩টি ক্ষেত্রে বিশ্বের দরবারে গৌরবোজ্জ্বল ও ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করেছে তার মধ্যে সবজি অন্যতম। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। বছরে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৬০ লাখ টন। বেসরকারি কোম্পানিগুলো সারা বছর চাষের উপযোগী হাইব্রিড বা উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বীজ উদ্ভাবন এবং তা বাজারজাত করার ফলে সবজি চাষে সাফল্য ও বৈচিত্র্য এসেছে। দেশে বর্তমানে ৬০ ধরনের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে, যার সঙ্গে জড়িত ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার।
সবজি উৎপাদনে ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করতে বাংলাদেশের সরকারগুলোর নীতি-সিদ্ধান্ত যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি উদ্যমী সাধারণ মানুষের অবদানও কম নয়। আবার উদ্যোক্তারা শত বিপত্তির মুখেও ব্যবসা–বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন বেসরকারি খাতনির্ভর অর্থনীতি। এভাবে সবার অবদানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে উত্থান ঘটেছে, তা আজ চোখ বড় করে দেখছে বিশ্ববাসী।
সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ ব্যাপক সফলতা অর্জন করলেও গ্রহণের দিক থেকে একেবারেই নিচের সারিতে অবস্থান করছে। মাথাপিছু চাহিদা অনুযায়ী সবজি গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিদিন একজন সুস্থ সবল মানুষের ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু দেশে মাথাপিছু সবজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে মাত্র ৭০ ভাগ। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলছে, দেশে প্রায় শতকরা ৩৫ ভাগ সবজি বিভিন্নভাবে অপচয় হয়ে থাকে। সংরক্ষণ,অযতœ আর অবহেলায় প্রতিবছর দক্ষিণাঞ্চলে হাজার হাজার টন সবজি নষ্ট হয়ে থাকে।
শুধু যশোর বছরে ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় আট লাখ টন সবজি উৎপাদন করে রেকর্ড অর্জন করেছে যশোরের কৃষকরা। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে তাদের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত সবজি পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্য দিয়ে দেশে সবজি উৎপাদনে শীর্ষ স্থান দখল করেছে তারা। যশোর কৃষি অফিস সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকায় শেষ হওয়া জাতীয় কৃষি মেলায় সবজি উৎপাদনে যশোর জেলাকে দেশসেরার স্বীকৃতি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। শাক-সবজি উৎপাদনে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন সর্বোচ্চ ও দেশের সবজির চাহিদা পূরণে বিশেষ অবদান রাখায় প্রথম হয়েছে যশোর। অন্যদিকে যশোর পরই সাতক্ষীরার অবস্থান। জেলার চাহিদা পূরণ করে তাদের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত সবজি পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
কথা হলো সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের সবজি চাষি মহিদুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান,প্রথম দিকে চাষপদ্ধতি সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় প্রত্যাশিত ফলন হয়নি। লাভের পরিমাণ এসেছে অপেক্ষাকৃত কম। এবছর মহিদুল ৪ বিঘা জমিতে আগাম জাতের শতিকালিন সবজির চাষ করে। এতে তার খরচ হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এবছর তার ২ লক্ষ টাকা বেঁচা কেনা হবে। এতে তার খরচ বাদে লাখ টাকা লাভ হবে। এর পর মহিদুল একই জমিতে পেঁয়াজের চাষ শুরু করবে। বেশ ভাল যাচ্ছে তার সবজি চাষ। অসময়ের বৃষ্টিতে সবজির ব্যাপক ক্ষতি হলেও তার সবজির খেতে তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। প্রতিবেশী জানান, একসময় অভাব-অনটনে দিনযাপন করতেন মহিদুল। সবজি চাষ করে সচ্ছলতা এসেছে তাঁর। এলাকার অনেকেই তাঁকে অনুসরণ করে চাষাবাদ করছেন।
জেলা কৃষি কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, উদ্যমী ও পরিশ্রমী মানুষ মহিদুল। আধুনিক পদ্ধতিতে বিষমুক্ত সবজি চাষে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। অনেকে তাঁকে অনুসরণ করে সবজি চাষে ঝুঁকছেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে এই কৃষি উদ্যোক্তাকে।
যদি উপকূলের এ কৃষি সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে কৃষি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে তা দেশের সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনের চিত্রকে বদলে দেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।