খুলনা: দুই সপ্তাহ আগে খুলনার ফুলতলায় ধর্ষণের পর তরুণী মুসলিমা খাতুনকে (২০) গলা কেটে হত্যা করে রিয়াজ খন্দকার (৩২) ও সোহেল সরদার (২৫)। মুসলিমা স্থানীয় আইয়ান জুট মিলে চাকরি করতেন।
তিন বোনের মধ্যে দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মুসলিমার অসুস্থ বাবা ইমদাদ হক মৃত্যুপথযাত্রী। মুসলিমা ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। দামোদরের ঋষি পাড়া রোডে বাবা-মাকে নিয়ে থাকতেন।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস গত ২৬ জানুয়ারি তাকে নির্মম, নিষ্ঠুরতম পাশবিকতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। আসামি গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু মুসলিমার অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে অসহায় পরিবারটির।
এমন অমানবিক ও নিষ্ঠুর ঘটনার পরও খুলনার কোনো নারীবাদী বা সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় আসেনি। বাড়ায়নি কেউ সাহায্যের হাত। যে কারণে নিরব দুর্ভিক্ষ আর নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে মুসলিমার অসুস্থ বাবা-মায়ের।
যেভাবে বেঁচে আছে মুসলিমার পরিবার: মুসলিমার মেঝ বোন আকলিমা খাতুন বলেন, মুসলিমা বেজেরডাঙ্গার আইয়ান জুট মিলে মেশিনম্যান হিসেবে ২ বছর ধরে কাজ করতো। প্রতিদিন হাজিরায় বেতন ছিল ২৪৫ টাকা। জুট মিলে স্থায়ী কাজ করা যায় কিন্তু মুসলিমা নিয়মিত যেতে পারতো না বলে স্থায়ী হয়নি। ছোট থেকে মুসলিমার নিমনিয়া ছিল। ধুলার মধ্যে গেলে ওর এলার্জি হতো, ঠাণ্ডা লাগতো। এ কারণে ও দুই দিন কাজ করলে একদিন করতো না। মুসলিমার মৃত্যুর পর মিল থেকে কোনো সহযোগিতা করেনি। সরকারি কোন সহযোগিতাও মেলেনি।
তিনি বলেন, ১৯ বছর ধরে আমরা ফুলতলার একই বাড়িতে ভাড়া আছি। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। মুসলিমার বিয়ে হয়নি, ওর আয়েই পরিবার চলতো। আমার আব্বার গত বছর পা ভেঙে যায়। আড়াই লাখ টাকা লাগবে সার্জারি করতে, তাই আমরা পারিনি। সাতক্ষীরার শ্যামনগরে আব্বার গ্রামের জমি বন্ধক রেখে চিকিৎসা করেছি। আব্বুর হার্নিয়া হয়েছিল। একটা কিডনি নষ্ট। এর মধ্যে বোনের মৃত্যুর তিন দিন আগে হার্টঅ্যাটাক করেছে। আমার বোনের যেদিন মৃত্যু হয়, সেদিন আমি ও আমার আম্মু খুলনা মেডিক্যালে আব্বুকে নিয়ে ভর্তি ছিলাম। কেউ কোনো আর্থিক সহযোগিতা করেননি। যেদিন রাতে আমার বোন নিখোঁজ হয়, সেই দিন থেকে আমরা প্রশাসনের অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। আমাদের কোন টাকা-পয়সা লাগেনি। আমাদের দৌড়ানোর মতো কেউ নেই, তারপরও প্রশাসন আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। এখন একটাই দাবি আসামিদের যেন ফাঁসি হয়। আমার দূরসম্পর্কের এক চাচাত ভাই সাতক্ষীরা মেডিক্যালের ডাক্তার, তাই সেখানে আব্বুকে ভর্তি করেছি। বাবার চিকিৎসার খরচ যোগার করার মতো আয়ের উৎস আর নেই। আব্বুর একটা ভ্যান ছিল তা বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছি। তার কিছু টাকা ছিল তা বোনের মরদেহের ময়নাতদন্ত, এদিক-ওদিক যেতে শেষ হয়ে গেছে। এখন খালি হাতে হাসপাতালে ভর্তি আছি বাবাকে নিয়ে। স্থানীয় মেম্বার বোনের মরদেহ ও মস্তক ময়নাতদন্তের দুই দিন ৫০০ অথবা ১০০০ টাকা দিয়েছিলেন। শুনেছি আসামি রিয়াজের একভাইকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছিল। আর এক ভাইকে মানুষে গণপিটুণি দিয়ে মেরে ফেলেছে। এই ছেলেটা যত অপকর্ম করে তা ওর বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় পার পেয়ে যায়।
কান্না জড়িত কণ্ঠে আকলিমা বলেন, আমার বোনের একটাই স্বপ্ন ছিল বাবা অসুস্থ, ঋণগ্রস্ত সেটা শোধ করবে। অনেক জায়গা থেকে সম্বন্ধ আসলেও বাবাকে ফেলে বিয়ে করতে রাজি হয়নি।
ধর্ষকদের পরিচয়: মুসলিমার ধর্ষক রিয়াজ ও সোহেল। ফুলতলার যুগ্নিপাশা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ খন্দকারের ছেলে রিয়াজ খন্দকার ও শিলন সরদারের ছেলে সোহেল সরদার। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রিয়াজ স্বীকার করেছে এর আগেও সে প্রতারণার মাধ্যমে অনেক মেয়ের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। রিয়াজের বড় ভাই ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। মেঝভাইকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলেছেন ক্ষিপ্ত জনতা। রিয়াজের বাবার মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
গত রোববার (৩০ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় মুসলিমা হত্যাকাণ্ডে নিজেদের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় রিয়াজ খন্দকার ও সোহেল সরদার। তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২ এর বিচারক নয়ন বিশ্বাস।
মুসলিমার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস: জনউদ্যোগ নারী সেলের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শামীমা সুলতানা শিলু বাংলানিউজকে বলেন, সত্যিই হৃদয় বিদারক, নির্মম বাস্তবতার মধ্যে দিনাতিপাত করছে মুসলিমার পরিবারটি। মর্মান্তিক এ ঘটনার আগে তাদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল মুসলিমা। এখন সমাজের বিত্তবান ও জনপ্রতিনিধিদের পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে মেয়েটি যেখানে কাজ করতো তাদেরও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে অচিরেই মানববন্ধন কো হবে।
খুলনা-৫ আসনের (ডুমুরিয়া ও ফুলতলা) সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ বাংলানিউজকে বলেন, আমার সাধ্যে যতটুকু কুলায় মুসলিমার পরিবারের জন্য আমি করব। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
ঘটনা প্রবাহ: হত্যাকাণ্ডের চারদিন আগে রাত সাড়ে ৯টার দিকে আইয়ান জুট মিলের গাড়িতে মিলের সামনে নামে মুসলিমা। সে সময় আসামি রিয়াজ সিগারেটের দোকানে বসে ধূমপান করছিল। মুসলিমাকে দেখে লোলুপ দৃষ্টি পড়ে রিয়াজুলের। মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করার জন্য হন্যে হয়ে পড়ে। এক সময় নম্বরও পেয়ে যায় সে। একের পর এক ফোন দিতে থাকে মুসলিমাকে।
প্রথম দিকে রিয়াজুলের ফাঁদে পা দিতে রাজি হয়নি মুসলিমা। পরে রিয়াজ ও তার বন্ধু সোহেল দুজনে মিলে পরিকল্পনা করে কীভাবে মেয়েটিকে রাজি করা যায়। এরপর সোহেলকে দিয়ে মুসলিমার কাছে ফোন দেওয়া হয়। বলা হয় দেখা না করলে রিয়াজ আত্মহত্যা করবে। তখন ওপাশ থেকে জানানো হয়, তার মা খুব অসুস্থ তাই আসতে পারবে না সে। এপরপর আবারও যোগাযোগ করা হয়। পরে রাজি হয় মুসলিমা।
২৫ জানুয়ারি রাতে রিয়াজের ফোন থেকে সোহেল মুসলিমাকে ফোন দেয়। ঘর থেকে বাইরে আসলে মুসলিমাকে নিয়ে প্রথমে বেজেরডাঙ্গা বাজারে নেওয়া হয় তাকে। সেখানে রিয়াজ তাকে বিয়ের আশ্বাস দেয়। সেখানে তারা তিনজন মিলে বাজারের বিভিন্নস্থানে ঘুরে বেড়ায়। এরমধ্যে রিয়াজ তার দুঃসম্পর্কের দুলাভাই ইউসুফকে ফোন দিয়ে একটি ঘর প্রস্তুত করতে বলে। ইউসুফ আবার ফোন করে যুগ্নিপাশা গ্রামের মুনসুরকে ঘরের জন্য জানায়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তারা তিনজন মিলে মুনসুরের একটি কক্ষে ঢোকে। কিছুক্ষণ পরে সোহেলকে ঘর থেকে বের হতে বলে রিয়াজ। প্রথমে মুসলিমাকে ধর্ষণ করে রিয়াজ। আধঘণ্টা পর সোহেল ওই ঘরে ধর্ষণের জন্য গেলে চিৎকার করে মুসলিমা। পরে ঘর থেকে বের হয়ে আসে সোহেল।
ধর্ষণ শেষে রিয়াজকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে মুসলিমা। বাইরে এসে তারা দু’জন আলোচনা করে ধর্ষণের ঘটনা ফাঁস হলে তাদের সামনে বিপদ আছে। তারা দু’জন মিলে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। রাত দেড়টার দিকে মুনসুরের বাড়ি থেকে বের হয় ওই তিনজন। নির্জন রাস্তায় এসে মুসলিমার মুখ চেপে ধরে সোহেল। গায়ের ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দেয় রিয়াজ। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দুই পাশ থেকে ওড়না টেনে রাখে তারা। মৃত্যুর পরও দু’জনে মুসিলমাকে ধর্ষণ করে। গায়ের ওড়না দিয়ে একটি গাছে মরদেহটি ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। যেন তাকে কেউ শনাক্ত না করতে পারে সেজন্য রিয়াজ বাড়ি থেকে ধারালো বটি এনে দেহ থেকে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে। দেহের অংশটি উত্তরডিহির রেজাউল মোল্লার ধান ক্ষেতে আর মাথাটি নিহতের পরিধেয় কাপড় দিয়ে আবৃত করে ওই এলাকার নজরুলের নির্মাণাধীন বাড়ির টয়লেটের বালুর নিচে পুঁতে রাখে তারা।
মরদেহ উদ্ধারের সময় রিয়াজ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। তখনও পুলিশ টের পায়নি। পুলিশ রিয়াজ সন্দেহে ওই এলাকার কয়েকজন রিয়াজকে আটক করে। কিন্তু তাদের মোবাইল নম্বরের সঙ্গে কারও নম্বর মিল পায়নি পুলিশ। মুসলিমার ফোন নম্বরের ইতিবৃত্ত বের করে প্রকৃত রিয়াজকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয় পুলিশ। কিন্তু এর আগে ফুলতলা ত্যাগ করে রিয়াজ। পালিয়ে বড় ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে আত্মগোপন করে। ২৯ জানুয়ারি সকালে পুলিশ এ হত্যাকারণ্ডর অভিযোগে সোহেলকে গ্রেফতার করে। আর শুক্রবার রাতে র্যাব রিয়াজের মোবাইল ট্রাকিং করে ফরিদপুরের কানাইপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে।
ধর্ষণের সহযোগিতার অভিযোগে পুলিশ মুনসুর খাঁ (৮০) এবং ইউসুফ আলীকে (৬৩) আটক করে জেলহাজতে পাঠায়।
বুধবার (২৬ জানুয়ারি) সকালে ফুলতলার উত্তরডিহি এলাকার ধান ক্ষেত থেকে মুসলিমার মস্তকবিহীন বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তখন তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। পরে মরদেহের আঙ্গুলের ছাপের মাধমে পরিচয় শনাক্ত করা হয়। শনিবার (২৯ জানুয়ারি) বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে ফুলতলার যুগ্নিপাশার নির্মাণাধীন ভবনের বাথরুম থেকে মুসলিমার মাথা উদ্ধার করে র্যাব।
নিহত মুসলিমার বোন আকলিমা খাতুন বাদী হয়ে ফুলতলা থানায় অজ্ঞাত ৫/৬ ব্যক্তিকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা (নং-১৩) দায়ের করেন। বাংলানিউজ