সব্যসাচী বিশ্বাস (অভয়নগর) যশোর:
যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলাসহ সারা দেশে আজ বাংলা ১৬ ফাল্গুন ১৪২৮ এবং ১ মার্চ ২০২২ মঙ্গলবার মহাশিবরাত্রি পালিত হলো। নানা উপাচারে নতুন বস্ত্র পরিধান করে কুমারী মেয়েরা সারারাত ধরে আদিদেব, মহাদেব শিবের আরাধণা করে।পূণ্যপ্রাপ্তি, মহাদেবের আশীর্বাদ প্রাপ্তির আশায় এই মহাশিবরাত্রি ব্রত পালন করে থাকে সনাতনধর্মাবলম্বী কুমারী মেয়েরা। শাস্ত্র মতে, সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র শিবই বর্তমান ছিলেন। তিনিই লীলাচ্ছলে ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপ ধারণ করে পালন করেন আবার রুদ্ররূপ ধারন করে সংহার করেন। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-হর তারই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের তিনটি রূপভেদ মাত্র।
তাই এই তিন রূপের মধ্যে সত্বার কোন পার্থক্য নেই। তবু সনাতন রূপ পরম শিবরূপই মূলস্বরূপ।
আশীর্বাদ লাভের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন মহাশিবরাত্রি। হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে মহাশিবরাত্রি উৎসব পালন করা হয়। হিন্দু ধর্মালম্বীদের জন্য শিবরাত্রি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন।
তবে শুধুমাত্র মেয়েরাই শিবের মতন বলিষ্ঠ ও বুদ্ধিমান স্বামী পাবার উদ্দেশ্যে এই ব্রত পালন করেন তা নয়, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে শাক্ত, বৈষ্ণব সবার কাছেই শিবরাত্রি এক অতি মাহাত্ম্যপূর্ণ দিন।
ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি ব্রত শুরু করে সারা রাত জেগে প্রহরে-প্রহরে পুজো করতে হয়। মহাশিবরাত্রির আগের দিন একবার হবিষ্যান্ন খেয়ে সংযত জীবন যাপন করার প্রথা রয়েছে। শিবরাত্রির দিন রাত্রি দ্বিপ্রহরে চারটি শিব পুজো করতে হয়। তার পরের দিন ব্রাহ্মন ভোজন করানোর রীতি রয়েছে। মহাশিবরাত্রিতে শিবরাত্রির ব্রতকথা পাঠ করা আবশ্যক।
মহাশিবরাত্রির ব্রতকথা
শিবমহাপুরাণ অনুসারে, বহুকাল আগে বারাণসী তথা কাশীধামে এক নিষ্ঠুর ব্যাধ বাস করত। সে দিনরাত শুধু জীবহত্যা করে বেড়াত। একদিন ব্যাধ শিকার করতে গিয়ে অনেক পশু পাখি শিকার করে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই সে বাড়ির দিকে রওনা হয়। কিন্তু কিছুদূর যেতেই পথে রাত্রি হয়ে যায়। ফলে সে জঙ্গলে পথ হারিয়ে রাতে হিংস্র জন্তুর ভয়ে এক গাছের উপর আশ্রয় নেয় ।
ব্যাধ যে গাছে আশ্রয় নিয়েছিল সেই গাছটি ছিল বেলগাছ। আর সেই গাছের নিচে ছিল একটি শিবলিঙ্গ। ব্যাধ গাছে নড়ে-চড়ে বসার সময় শিশির জলে ভেজা কয়েকটি বেলপাতা খসে পড়ে ঐ শিবলিঙ্গের মাথার উপর। সেদিন ছিল শিবচতুর্দশী অর্থাৎ মহাশিবরাত্রি।
আর ব্যাধও ছিল উপবাসী। তার ফেলা বেলপাতাগুলো শিবলিঙ্গের মাথায় পড়ে এর ফলে তার শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ হয় তার অজান্তেই। পরদিন ব্যাধ সকালে বাড়ি ফিরে আসে। সে রাতে বাড়ি না ফেরায় সবাই তার জন্য ভাবছিল।
ব্যাধ ফিরে আসতে তাকে তার বৌ খেতে দিল। এমন সময় একজন অতিথি বাড়িতে এলো। ব্যাধ কি ভেবে তার নিজের খাবারগুলি অতিথিকে দিল। এতে তার ব্রতের পারণ ফল লাভ হলো।
এর কিছুদিন পরে সেই ব্যাধ মারা গেলে। যমদূতরা তাকে নিতে আসে, এমন সময় সেখানে পৌঁছয় শিবের দূতেরা। কে ব্যাধকে নিয়ে যাবে তাই নিয়ে দুই দলে যুদ্ধ বেধে যায়। যমদূতেরা যুদ্ধে হেরে গেলে শিবদূতরা ব্যাধকে কৈলাসে নিয়ে যায়।
যুদ্ধে হেরে গিয়েও যমদূতেরা তার পিছনে পিছনে সেখানে ধাওয়া করে। কৈলাসের দ্বারে নন্দী পাহারায় ছিল। সে ব্যাধের শিব রাত্রির কথা বললে সব শুনে যমদূতেরা গিয়ে যমকে সব কথা বলে।
যমরাজ শুনে বললেন ‘হ্যাঁ, যে শিব বা বিষ্ণুর ভক্ত কিংবা যে শিবচতুর্দশী ব্রত পালন করে আর যে বারানসী ধামে মরে, তার উপর যমের কোনো অধিকার থাকে না। তার মুক্তিলাভ ঘটে। এইভাবে মর্ত্যলোকে শিবচতুর্দশী ব্রতের প্রচার ঘটে।’
মহাশিবরাত্রি পালন করলে জন্ম ও মৃত্যুর এই চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে প্রচলিত বিশ্বাস। এমনকি মহাশিবরাত্রি পালন করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের থেকেও বেশি পূণ্য পাওয়া যায় বলে মনে করা হয়।
শিবরাত্রিতে উপবাসের নিয়ম
* শিবরাত্রির ভোর থেকে উপবাস রাখতে হয়। সারা দিন এবং সারা রাত উপবাস চলে। পরের দিন পঞ্জিকা অনুসারে পরানার সময় উপবাস ভঙ্গ করতে হয়।
* শিবরাত্রির উপবাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মনকে খারাপ চিন্তা থেকে দূরে রাখা। খারাপ সঙ্গ এবং খারাপ কথা থেকে নিজেকে দূরে রাখা উচিত শিবরাত্রিতে। এদিন ভালো কথা বলুন এবং ভালো কথা চিন্তা করুন।
* মহাশিবরাত্রিতে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পূণ্যার্থীকে গঙ্গা বা যমুনার মতো কোনও নদীতে স্নান সেরে নিতে হবে। যদি একান্তই নদীতে স্নান করা সম্ভব না হয়, তখন জলের মধ্যে কয়েকটা তিল ফেলে গরম করে সেই জলে স্নান করুন।
* উপবাস রাখার সঙ্গে গোটা রাত জেগে শিবের পুজো করতে হয়। তবেই শিবরাত্রির পূণ্যফল পাওয়া সম্ভব। খাবার তো নয়ই, শিবরাত্রির জলও খাওয়া যায় না। তবে কেউ কেউ দুধ, জল ও ফল খেয়ে শিবরাত্রির উপবাস পালন করেন।
* শিবরাত্রিতে মন্দির প্রাঙ্গনেই থেকে সারাদিন শিবের নামগান শুনে কাটালে মন পরিশুদ্ধ হয়, তবেই শিবরাত্রি পালনের উপকার পাওয়া যায়।
* শিবরাত্রিতে শুধু উপবাস পালন নয়, সঙ্গে নিজের শরীর ও মনকে শুদ্ধ করতে হবে। নিজের কামনা বাসনার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।
* দুধ, মধু, সুগন্ধী, ফুল ও নতুন বস্ত্র দিয়ে কোনও মন্দিরে গিয়ে শিবলিঙ্গের পুজো করাতে পারেন। শিবলিঙ্গের স্নানের সময় মহাদেবের বিভিন্ন নামগুলি উচ্চারণ করুন।
* হলুদ, চন্দন, কুমকুম, বেলপাতা, ফুল ও নতুন বস্ত্র দিয়ে শিবমূর্তিকে সজ্জিত করুন। এরপর মহাদেবের সামনে কর্পূরের প্রদীপ জ্বালান। এরপর ধূপকাঠি জ্বালিয়ে মন্দিরের ঘণ্টা বাজিয়ে মহাদেবের আরাধনা করুন।
উপরোক্ত সকল নিয়ম অনুসরণের মাধ্যমে শিবরাত্রি পালিত হয়ে থাকে।