আবু সাইদ বিশ্বাস: উপকূলীয় অঞ্চল ঘুরে ফিরেঃ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বিপদাপন্ন জেলা সমূহের মধ্যে উপকূলীয় ১৪ জেলাবিবেচিত হচ্ছে। সবুজ বেষ্টনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় উপ্র্র্রকূল ঘিরে থাকা প্র্র্রানি উন্নয়ন বোর্ডের মোট ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্র্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা-খুলনা-বাগেরহাট উপ্র্র্রকূলের ৪২৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধই রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। জলোচ্ছ্বাসসহ সামুদ্রিক ঝড় থেকে উপ্র্র্রকূলীয় জনপ্র্র্রদ রক্ষায় বন বিভাগ প্র্র্র্যারাবনসহ যে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলেছিল, তার বেশির ভাগই অবজ্ঞা, অবহেলা আর তদারকহীনতায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অন্যদিকে ভয়াল দুর্যোগের থাবা থেকে জানমাল রক্ষায় উপ্র্র্রকূলীয় জনপ্র্র্রদে নির্মিত আশ্রয় কেন্দ্রগুলোও দীর্ঘ সংস্কারহীনতায় ব্যবহারের অনুপ্র্র্রযোগী হয়ে প্র্র্রড়েছে। ফলে অরক্ষিত উপ্র্র্রকূলীয় এলাকার ৪ কোটি মানুষ আছে চরম ঝুঁকিতে, সীমাহীন আতঙ্কে। এরই মধ্যে উপকূলের মানুষের দূরাবস্থার স্বচিত্র দেখে বিশ্মিত হন ডেনমার্কের রাজকুমারী ক্রাউন প্রিন্সেস মেরি এলিজাবেথ ডোনাল্ডসন। তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরের গতকাল ২৭ এপ্রিল সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কুলতলী গ্রাম পরিদর্শনে যান এবং সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের জীবনে কি ধরনের পরিবর্তন এসেছে, কি ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। সাধারণ জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বলা শেষে রাজকুমারী নিকটবর্তী একটি বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার পরিদর্শনে যান এবং ঘূর্ণিঝড়ের সময় এটি কিভাবে ব্যবহার করা হয়, এর ব্যবস্থাপনা কিভাবে হয় ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা নেন
গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্থ দেশের মধ্যে প্রথমদিকে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরের সাথে বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রয়েয়ে। দিনে দিনে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশ।বিশেজ্ঞরা বলছে সমুদ্রপৃৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে তলিয়ে যাওয়া অঞ্চল থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হতে পারে। বাংলাদেশে একাধাওে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা ইত্যাদি সবগুলো দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং হচ্ছে।
প্র্র্রানি উন্নয়ন বোর্ড (প্র্র্রাউবো) জানায়, সুপ্র্র্রার সাইক্লোন সিডরে উপ্র্র্রকূলীয় ৩০ জেলার ২ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্থ হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয় ৩৯১ কিলোমিটার। ১ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্র্র্রাউবো দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মেরামত ও সংস্কার করলেও প্র্র্রূর্ণিমার সামান্য জোয়ারেই এসব বাঁধ ভেঙে প্র্র্রানি ঢুকে প্র্র্রড়ে জনপ্র্র্রদে। উপ্র্র্রকূলীয় বাসিন্দাদের সুরক্ষিত রাখতে সরকার শত শত কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তাদের ঝুঁকিমুক্ত জীবন নিশ্চিত হচ্ছে না কোনোভাবেই।
প্র্র্রানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের ১৯ জেলার ১৪৭ উপ্র্র্রজেলার ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা উপ্র্র্রকূলীয় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ উপ্র্র্রকূলীয় এ জনপ্র্র্রদে বসবাস করেন প্র্র্র্রায় ৪ কোটি মানুষ। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় জীবনধারণে বাধ্য হন তারা। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসংখ্য মানুষ তাদের বসতভিটা ও কৃষিজমি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস বারবার আঘাত হানার কারণে সড়ক অবকাঠামো, বসতবাড়ি, কৃষিজমি বিনষ্ট হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষি ক্ষেত্রে। কৃষি নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। গত শতাব্দীতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ২৩%, নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ১৯% এবং মিথেনের পরিমাণ বেড়েছে ১০০% । বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতা বা হুমকি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে জনসংখ্যার যে অংশটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন, তারা হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সমুদ্র তীরবর্তী ভৌগোলিক অবস্থান, মাত্রাতিরক্ত জনসংখ্যা, অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং এর ওপর অধিক নির্ভরশীলতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের বিপন্নতা খুবই ভয়াবহ।
১৯৭৩ সনে ১৫ লাখ হেক্টর জমি মৃদু লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয় উপক’লীয় জেলা সমূহ, যা ১৯৯৭ সনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ হেক্টেরে। বর্তমানে এর পরিমাণ প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর। উজান থেকে পানিপ্রবাহ বাধা ও কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পরিমিত বৃষ্টিপাতের অভাবে আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের মোট উপকূলীয় এলাকা প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর, যার মধ্যে বর্তমানে প্রায় ১০.৫০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত।
স্যাটেলাইট চিত্র থেকে দেখা যায়, ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সন পর্যন্ত ১,০৬,৩০০ হেক্টর নদী তীরের ভাঙনের বিপরীতে মাত্র ১৯,০০ হেক্টর নতুন ভূমি গঠন হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে ভাঙা গড়ার এ ভারসাম্য আরও প্রকট হবে।
আবু সাইদ বিশ^াস
সাতক্ষীরা: ২৭/০৪/২২ ০১৭১২৩৩৩২৯৯