সমাজ বদলে যাচ্ছে : বাড়ছে অর্থবিত্তের অসম প্রতিযোগিতা – বিলাল হোসেন মাহিনী

ব্যবাসায়ীদের হাতে জিম্মি দেশ ! এদিকে চিড়েচ্যপ্টা সাধারণ মানুষ। অর্থই যেন একমাত্র লক্ষ্য। তবে প্রবাদে আছে ‘অর্থই অনর্থের মূল’। তবুও মানুষের জীবনে অর্থবিত্তের প্রয়োজনকে অস্বীকার করা যায় না। ঠিক কী পরিমাণ অর্থবিত্ত থাকলে জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে কাটবে তা কেউ বলতে পারে না। তাই কিছু মানুষ অসম প্রতিযোগিতার মোহে অর্থ সঞ্চয় ও সম্পদের পাহাড় গড়তে মরিয়া। সমাজে কারো পৈতৃক সূত্রেই  প্রচুর সহায়সম্পত্তি থাকে, সেই সাথে নিজের উপার্জিত সম্পদ যোগ হয়। ব্যক্তির মৃত্যুর পরও কয়েক পুরুষ যেন অভাবগ্রস্থ না হয় সে জন্য কারো কারো চেষ্টার শেষ নেই। দিন শেষে মানুষ শান্তি চায়। শান্তির জন্য অঢেল বিত্তবৈভবের দরকার নেই। বাস্তবতা হলো, সুখী মানুষের জামা থাকে না। জামা-কাপড়, দামি গাড়ি-বাড়ির চাহিদা যার নেই, সুখী তো সে হবেই। মানুষের মতো মানুষ হলে অনৈতিক পথে অঢেল সম্পদের প্রয়োজন নেই। স্বল্প সম্পদে আত্মতৃপ্তি নিয়ে মহান স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল থাকা মানুষগুলোই প্রকৃত মানুষ। এর জন্য লাগে প্রকৃত ও নৈতিক শিক্ষা। একমাত্র পরিবার বা মাতা-পিতা থেকে এ শিক্ষার সূচনা হয়ে থাকে।

বয়স বাড়ে, বার্ধক্য আসে, বার্ধক্যে মৃত্যু কামনায় থাকে বেশিরভাগ মানুষ। প্রচুর অর্থ-সম্পদ বার্ধক্যকালে কাজে তেমন কাজে লাগে না। তবে সন্তানদের মনোযোগ ও সেবা-শুশ্রƒষার প্রাপ্তি প্রত্যাশা করে প্রায় সকলেই। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজে এই স্বাভাবিকতার ব্যত্যয় ঘটে মাঝে মধ্যে। দেখা যায় বার্ধক্যকবলিত মানুষটির সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সন্তানদের টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে বৃদ্ধ ব্যক্তির শেষ জীবনকাল হয়ে ওঠে বিষময়। সমাজ পরিবর্তনে বৃদ্ধাশ্রমের দেখা মিলছে। ভেঙে যাচ্ছে বড়ো পরিবারগুলো। পিতা-মাতা ও বৃদ্ধরা যেনো পরিবারের বোঝা হয়ে যাচ্ছে। গতিময় থেকে গতিশীল হয়ে যাচ্ছে জীবন। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় প্রবেশ করছে পৃথিবী।

আমাদের দেশে শেষ বয়সের মানুষের নিরাপত্তা হুমকির মুখে। সন্তান, নাতি-নাতনী ও স্বজনহারা হয়ে নিরবে-নিভৃতে মনোকষ্টে বহু প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। যার খবর পত্র-পত্রিকায় দেখা মিলছে মাঝে মধ্যে। শেষ জীবনে যারা অসহায় হয়ে পড়ছেন তাদের বেশিরভাগ অঢেল সম্পদের মালিক। যাদের সন্তানরা দেশের বাইরে থাকেন অথবা কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত। এই তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে শুরু করে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী-এমপিও রয়েছেন। মূলতঃ তাদের বিপুল অর্থ-সম্পদ নিয়েই চলে বিবাদ। একদিকে রেখে যাওয়া অর্থের ভাগবটোয়ারা, অন্যদিকে সঙ্গীহীন অসহায়ত্ব। কী পাবে এই বিত্তবৈভবে?
মৃত্যের সম্পদের প্রতি সন্তনদের লোভ-লালসায় কতো মানুষ জীবন দেয় তা বলে শেষ করা যাবে না। বৃদ্ধ মা-বাবাকে পিটিয়ে জখম, আঘাতে মেরে ফেলা, রহস্যজনক আগুনে মৃত্যু- এগুলো আমাদের সমাজেই ঘটছে, যা মাঝে মধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়। এ ছাড়া বোন-ভাই বা অসহায় জনকে পাগল সাজিয়ে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে আর খোঁজখবর না নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। সহায়সম্পদ আত্মসাতের জন্যই বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে। সম্পদের মোহে মানুষ নদী দখল করে, পাহাড় কাটে, অন্যের জমি দখল করে, বন উজাড় করে, সরকারি জমি দখল করে। কিন্তু কী হয় তাদের? তারা কী এক জীবনে সব খেয়ে যেতে পারে? পারে না। বরং মৃতের পরিত্যক্ত (বৈধ বা অবৈধ) অঢেল সম্পত্তি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের সহায়সম্পদ কম থাকলে বৃদ্ধকালে অসহায়ত্বেও যেমন শেষ থাকে না। তেমনি অঢেল সম্পদ থাকলেও একাকিত্ব ও অসহায়ত্বের বিড়ম্বনা পোহাতে হয়।
দেখা যায়, ধনী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খেদমতে কাজের মানুষ রেখে বা হাসপাতালে দিনের পর দিন ভর্তি রেখে কাছের মানুষেরা ব্যস্ত দিন অতিবাহিত করে বা প্রবাসী সন্তানরা কেয়ারটেকার রাখে। জীবন পাল্টে গেছে। খুব দ্রুতই সমাজ ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা উন্নত দেশের মতো ব্যস্ত জীবনে পদার্পন করছে। ফলে পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, স্বজন ও পরিবারকে সময় দেয়ার ‘সময়’ থেকে ছুটি নিচ্ছে সন্তানরা। সহায়সম্পদ নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি, মামলা-মোকদ্দমা এই সমাজের কালচারে পরিণত হয়েছে।
সম্পদ ডেকে আনে বিপদ। এই বিবাদ একদল মানুষসংশ্লিষ্ট। এখন অর্থ-বিত্ত সমাজের সীমিত সংখ্যক মানুষের হাতে ঘুরপাক খাচ্ছে। সমাজের একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ গরিব হয়ে পড়ছে। ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। একজনের ধন আছে, অন্যজনের নেই বা কম আছে- এমন লোকদের মধ্যে একশ্রেণী অন্যের সম্পদ লুটে নিচ্ছে। মূলত হিংসা থেকেই দখল, বেদখল, চুরি-ডাকাতি, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সীমিত সম্পদে তুষ্ট ও তৃপ্ত থাকার প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারলে এবং পরকালমূখী জীবন-যাপন করতে পারলে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা সম্পন্ন সমাজ গঠন সম্ভব হবে। সাথে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কেননা, প্রতিটি ধর্মই মানুষকে পিতা-মাতা ও বৃদ্ধ স্বজনদের খেদমতে অনুপ্রাণিত করে। অপরের অধিকার রক্ষা ও স্বল্প সম্পদে তুষ্ট থাকতে শেখায়।

বিলাল হোসেন মাহিনী
পরীক্ষক, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক-গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর।
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর।

Please follow and like us:

Check Also

বেড়িবাঁধ কেটে নোনাপানি ঢুকিয়ে ঘের ব্যবসা

সুন্দরবন–সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলায় যত্রতত্র বেড়িবাঁধ কেটে ও ছিদ্র করে পাইপ দিয়ে নোনাপানি উঠিয়ে চলছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।