পদ্মা সেতু চালু হলে যশোরে কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে

রহিদুল খান : পদ্মা সেতু নিয়ে দেশবাসীর স্বপ্নের শেষ নেই। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ স্বপ্নে বিভোর। যারপরনাই স্বপ্ন দেখছেন যশোরের লাখ লাখ মানুষ। যশোরসহ এই অঞ্চলের কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টরা রীতিমতো বিপ্লব হবে বলে মনে করছেন। কৃষক, আড়তদার, ব্যাপারি, পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা, সুধিমহল, সরকারি কর্মকর্তা সবার একই কথা, ‘যশোরে ঘটবে কৃষি বিপ্লব’।

দেশের মানুষের চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ করে যশোরের সবজি। এখানকার সবজি কেবল দেশ না, বিদেশের বাজারেও যায়। অথচ কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। অনেক সময় লোকসানের মুখে পড়েন তারা। এর একমাত্র কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। যশোর থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অধিকাংশ সবজি ট্রাকে করে নেয়া হয়। আর এই ট্রাক যায় আরিচা ফেরি দিয়ে। ফেরিতে অধিকাংশ সময় যানজট লেগেই থাকে। এ কারণে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো সময়মতো পার হতে পারে না। অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ফলে, কাঁচাপণ্য বিশেষ করে সবজির গুণগত মান নষ্ট হয়। আবার অনেক সময় পঁচে যায়। বেশিরভাগ সময় ব্যাপারিরা রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাজার ধরতে পারেন না। এ কারণে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এমনকি লোকসানের কারণে ইতিমধ্যে বারীনগর হাটের তিনজন ব্যাপারি তাদের ব্যবসা গুটিয়েও নিয়েছেন।

দুলাল মিয়া। ঢাকার শনির আঁখড়ায় বাড়ি। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে কাঁচামালের ব্যবসা করছেন। যশোরের বারীনগরসহ বিভিন্ন হাট থেকে সবজি কিনে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে গেলে চার জায়গায় টোল দিতে হবে। এগুলো হচ্ছে, আড়িয়ালখাঁ, কুচিয়ামোড়া, পোস্তগোলা ও পদ্মাসেতু। তবে, পদ্মা সেতুতে সময় বাঁচবে। রাতের বাজার ধরা যাবে। আর এটি হলে ব্যাপারিরা লাভবান হবেন বলে জানান তিনি।

সুলতান ব্যাপারি। বাড়ি নরসিংদি। ১৯৭৩ সালের পর থেকে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, যারা ঢাকায় সবজি বিক্রি করেন তাদের জন্য পদ্মা সেতু আশীর্বাদ। কারণ এই সেতু দিয়ে গেলে সময় বাঁচবে। আর কম সময়ে ঢাকায় পৌঁছালে ভালো ব্যবসা করা যাবে।

২৫ বছর ধরে ব্যবসা করছেন আব্দুল মালেক ব্যাপারি। বাড়ি চট্রগ্রাম। ব্যবসা করেন সেখানকার বাজারে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে চট্রগ্রামের ব্যবসায়ীদের জন্য দারুন এক সুখবর হবে। কারণ ফেরি পার হতে যে সময় লাগে সেই সময়ে ঢাকা রেখে চলে যাওয়া যাবে। ফলে, অপেক্ষাকৃত টাটকা সবজি ক্রেতাদের হাতে দেয়া যাবে। আর এটি দিতে পারলে দু’পয়সা বেশি নেয়া যাবে।

ঝুনু মিয়া চট্রগ্রামের ব্যাপারি। ৩০ বছর ধরে সবজির ব্যবসা করছেন তিনি। ঝুনু মিয়া বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে ব্যবসায়ীদের সুবিধা হবে। আগে যাওয়া যাবে। বাজার ধরা যাবে।

ইমন কাজী নামে একজন ট্রাকচালক বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে যেতে পারলে সুবিধা হবে। ফেরিতে যে ভাড়া দিতে হয় সেই খরচে পদ্মা পার হওয়া যাবে। সময় বাঁচবে। মালিকের লোকসান কম হবে। সময়মতো পৌঁছাতে পারলে ব্যাপারিরা সবজির দাম বেশি পাবেন। তখন তারাই ভাড়া বাড়িয়ে দেবেন।

কামরুল হাসান নামে আরেকজন ট্রাকচালক বলেন, তিনি যশোর থেকে সবজি নিয়ে নোয়াখালি যান। পদ্মা সেতু দিয়ে যেতে পারলে ফেরিঘাটের মতো বসে থাকা লাগবে না। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। এতে চালক-ব্যবসায়ী সকলেই লাভবান হবেন।

যশোর সদর উপজেলার আব্দুলপুর এলাকার চাষি হাদিউজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষক লাভবান হবেন। কারণ তখন ব্যাপারি বেশি আসবে। এ কারণে দামও বাড়বে। তাছাড়া, কৃষক চাইলে পিকআপে ভরে তার সবজি কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই ঢাকায় নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন।

আব্দুলপুর বাজারের আড়তদার গোলাম রসুল বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে যশোরে সবজির বাজার আরও জমজমাট হবে। তখন অনেক ব্যাপারি আসবে। প্রতিযোগিতা করে সবজি কিনবে। এর ফলে দাম বেশি হবে। কৃষক লাভবান হবেন।

আমিন উদ্দিন নামে একজন চারা উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে যশোরে কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে। দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারিরা সকালে এসে চারাসহ অন্যান্য সবজি কিনে সন্ধ্যার আগেই স্ব স্ব এলাকায় পৌঁছাতে পারবেন। ফলে, তারা ভালো দাম পাবেন।

যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর যশোরে সবজির আবাদ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১৫ হাজার ১শ’ হেক্টর জমিতে। এ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ১শ’ ৪৫ হেক্টরে। তবে, রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২ মৌসুম মিলিয়ে যশোরে ৪২ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদন হয় বলে সাবেক ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক দীপংকর দাস জানান। তার দাবি, ফেরিঘাটে নানা কারণে কমপক্ষে ২০ শতাংশ সবজি নষ্ট হয়। তার মতে, পদ্মা সেতু চালু হলে নষ্টের পরিমাণ অনেকাংশে কমে যাবে। লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরা।

সদর উপজেলা কৃষি অফিসার শেখ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে যশোরের কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে। পণ্য নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এ কারণে বেশি সংখ্যক ব্যাপারির আগমন ঘটবে। চাষি তাদের উৎপাদিত পণ্যের বেশি দাম পাবেন। আর যখন বেশি দাম পাবেন তখন সকলে বেশি করে সবজি উৎপাদন করবেন।

Please follow and like us:

Check Also

আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা হবে ৫ ঘণ্টার

২০২৫ সালে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।