পদ্মা সেতুর সম্ভবনাকে কাজে লাগাতে পদ্মা প্লাস পরিকল্পনার দাবী

আবু সাইদ  বিশ্বাস,সাতক্ষীরাঃ পদ্মা সেতুর সুফল ঘরে তুলতে পদ্মা প্লাস পরিকল্পনার দাবী উঠেছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন পরবর্তি সঠিক পরিকল্পনা নিতে না পারলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ২১টি জেলার কয়েক কোটি মানুষ পিছিয়ে থাকবে। বিশেজ্ঞরা বলছে,বঙ্গবন্ধু সেতু যখন করা হয়েছিল, তখন ‘সেতু-প্লাস’ কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এর সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সুবিধা দেওয়া বা বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নয়নের বিষয়গুলো ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধু সেতুর শুরুর বেশ কয়েক বছর কাঙিক্ষত ফল পাইনি উত্তরাঞ্চলের মানুষ। গড়ে ওঠেনি তেমন কোনো শিল্পকারখানা । কারণ শুধু সেতু করেই সব শেষ করা হয়েছিল। কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা হয়নি। তবে পদ্মা সেতুর অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে একটি পদ্মা প্লাস পরিকল্পনা দরকার। সেই সঙ্গে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমানোর দাবী সংশ্লিষ্টদের। যাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়। কারণ বিনিয়োগ না হলে শুধু সেতু করে কাঙিক্ষত সুফল পাওয়া যাবে না।
রাজধানী বিশেজ্ঞরা বলছে, যে সময়টা ফেরির জন্য পদ্মায় ব্যয় হত, সেই সময়টা এখন যাবে ঢাকায়। তারা বলছে ঢাকা প্রতিনিয়ত ফ্লাইওভাবে ৪০-৪৫ মিনিট জ্যামে পড়তে হয়। এখন নতুন যে ট্রাফিক ফ্লো হবে, সেটার চাপ নেওয়ার মত সক্ষমতা নেই।” হাদীউজ্জামানের ভাষায়,“পদ্মায় ফেরি পার হয়ে এতদিন ঢাকার দিকে গাড়ি আসত ধাপে ধাপে। এখন সেতু হওয়ার গাড়ি ঢাকায় আসবে খুব দ্রুত, সংখ্যাও বেশি হবে। এবার ঢাকা থেকেও একইভাবে বের হতে চাইবে। তাতে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা পড়বে উভমুখী সংকটে। “আমি বলব, ইনার সার্কুলার রুটের গাবতলী সোয়ারীঘাট হয়ে কেরানীগঞ্জের সাড়ে ১২ কিলোমিটার অংশ অগ্রাধিকার দিয়ে করে ফেলা উচিৎ। বিদেশি অর্থায়ন না পেলে প্রয়োজনে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে করতে হবে, এটা করা জরুরি। ঢাকার যানজট সামলাতে ব্যর্থ হলে পদ্মা সেতুর সুফল অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন পুরকৌশলীরা।
সমুদপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অঞ্চল ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। লবণাক্ততা বাড়ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগও বেশি দেখা দিচ্ছে। তাই পদ্মা প্লাস দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অঞ্চলকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পের জন্য জমির বরাদ্দ দিলে কৃষিজমি যেমন বাঁচবে, তেমনি বিনিয়োগকারীরাও এক জায়গায় সব সুবিধা পাবেন। পদ্মা সেতু চালু হলে পণ্যবাহী যানবাহনের একটা অংশ হবে ভারতের। দেশটির পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশে পণ্য পরিবহন হবে এই পথে। এডিবির ধারণা অনুযায়ী, শুরুর দিকে প্রতিদিন এই সেতু দিয়ে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করবে, পরে তা আরও বাড়বে।
বিশেজ্ঞরা বলছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। এটি বন্যাপ্রবণ অঞ্চল। আধুনিক কর্মকৌশল ব্যবহার করে কীভাবে রাস্তাঘাটসহ বন্যা-প্রতিরোধী অবকাঠামো করা যায়, সেটি মাথায় রাখতে হবে। বিনিয়োগ পরিস্থিতির বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার। রাস্তাঘাটই কিন্তু বিনিয়োগের একমাত্র অনুঘটক নয়। সহজ সুদে ঋণ, দক্ষ শ্রমিক ও জমির প্রাপ্যতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন দরকার ‘পদ্মা প্লাস’ উদ্যোগ। পদ্মা সেতু উন্নয়নের একটি বড় অনুঘটক। এটিকে কেন্দ্র্র করে যদি বিনিয়োগের অন্যান্য শর্ত পূরণ করতে পাওে সরকার, তবে উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ সম্ভব।
পদ্মা সেতুর ফলে আগামী ৫ বছরে ১০ লাখ এবং ১০ বছরে ওই সব জেলায় ৩০-৪০ লাখ নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। শুধু বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় আগামী ১০ বছরে ৫০০-১০০০ নতুন কারখানা স্থাপন হবে। ফলে ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা যোগ হবে দেশের অর্থনীতিতে। এই সেতু চালু হওয়ার পর ভারত ও নেপাল থেকে পর্যটক সংখ্যা বাড়বে। পর্যটন শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য কমবে ১.০১ শতাংশ। জাতীয়ভাবে দারিদ্র্য কমবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সহজলভ্য হওয়ায় ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরের ওপর চাপ কমবে। বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে প্রবন্ধে বলা হয়, ৩ কোটি মানুষ পদ্মা সেতুর কারণে সরাসরি উপকৃত হবে। কৃষি পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত হবে। কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে। কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ঘটবে। এ সেতু হওয়ায় ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে পশ্চিমবাংলার যোগাযোগ অনেক সহজ হবে। ফলে তারা এই সেতুকে অর্থনৈতিক করিডোর হিসাবে ব্যবহার করায় বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হবে। সেতুটির ফলে সরাসরি সড়ক ও রেলসংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে মোংলা, পায়রা, এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কসহ ভারতের ৭টি প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যাতায়াতের সময় ও দূরত্ব কমে আসবে।
পদ্মা সেতু ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব শীর্ষক প্রবন্ধে আরও বলা হয়, এডিবির মতে আগামী ৩১ বছরে যোগাযোগ খাতে পদ্মা সেতু থেকে আয় হবে ১৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা নির্মাণ খরচের ৫ দশমিক ৫ গুণ। এ ছাড়া সামাজিক অগ্রগতি অর্থনীতিতে যোগ করবে ২৫ বিলিয়ন ডলার। দুই পাড়ে নদী শাসনের মাধ্যমে যে জমি রক্ষা হয়েছে তার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সেতুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ গ্যাস এবং ইন্টারনেট লাইন গিয়ে সাশ্রয় করবে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফেরি চলাচল না হওয়ায় খরচ সাশ্রয় হবে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতু ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। রাজধানীর কাওরান বাজারে নিজস্ব কার্যালয়ে এ সভার আয়োজন করে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যাটস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষের প্যানেল অব এক্সপার্টেও চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এম শামীম জেড বসুনিয়া।
আর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এত সমস্যার কথা না ভেবে পদ্মা সেতু হলে কত মানুষ উপকৃত হবে, সেদিকে তাকানোর পরামর্শ দিলেন। তিনি বলেন, “একটা বড় সেতু উদ্বোধন হচ্ছে, সেখানে দেশের সকল মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। সেখানে অনেক গাড়ি ঢাকায়স্ত্রবেশ করবে, বের হবে, সেখানে ঢাকায় চাপ একটু হবেই, সেটা মোকাবেলার পরিকল্পনা আমাদের আছে। আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে আমরা এগোচ্ছি।”
পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এটি বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এই সেতু ব্যাপক পরিবর্তন আনবে এমনটাই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Please follow and like us:

Check Also

২৮শে এপ্রিল খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবারেও ক্লাসের পরিকল্পনা

আগামী ২৮শে এপ্রিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সব রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।