পিছিয়ে পড়া ২১টি জেলার ভাগ্য খুলছে ২৫ জুন

আবু সাইদ বিশ্বাস:   রাত পার হলেয় ২৫ জুন শনিবার। সকাল ১০টায় মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশ করে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন নামফলক উন্মোচন করে টোল দিয়ে পদ্মা সেতু পার হবেন তিনি। এরপর অন্য প্রান্তেও নামফলক উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন বিকেলে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেবেন তিনি। সেতু উদ্বোধন করতে ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জনসভা সফল করতে এরই মধ্যে দলের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি সভা, দক্ষিণাঞ্চলের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা এবং মঞ্চস্থল পরিদর্শনসহ নানা কাজ সম্পন্ন করেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা। পাশাপাশি মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশ সফল করতে সব আয়োজন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে আমন্ত্রণ পেয়েছেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, নির্মাণ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা। অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ২০ জুন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সুধীদের আমন্ত্রণপত্র পাঠায় সেতু বিভাগ। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য সুখবর
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যবদলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে পদ্মা সেতু। এই সেতু ঘিরেই সোনালি ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন এই অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চল ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও মনোযোগ কাড়বে, গড়ে উঠবে এসব জেলায় নতুন নতুন শিল্প কারখানা। এ সেতু দিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারবে এশিয়ান হাইওয়েতে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ২১টি জেলা হচ্ছে- খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা; বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী।
নির্মাণে সময় ও ব্যয় বেড়েছে দফায় দফায়
নানা কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় ও ব্যয় দুটিই বেড়েছে। শুরুতে এর ব্যয় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ধরা হলেও সর্বশেষ তা তিনগুণ বেড়ে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়। অপরদিকে নকশা প্রণয়ন শুরুর পর ২০১৩ সালে সেতু চালুর ঘোষণা থাকলেও নানা জটিলতায় তা বার বারই পেছাতে হয়েছে। এই সেতু জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২২ সালের মার্চে। এক পর্যায়ে সেটিও সম্ভব হয়নি। অবশেষে আগামী ২৫ জুন কাক্সিক্ষত এই সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পেলেও বর্তমানে এটির ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জানা গেছে, ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেকে শুরুতে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের পর ২০১৩ সালে সেতু চালুর ঘোষণা থাকলেও পরবর্তীতে নির্মাণের ঠিকাদার নিয়োগের পর ২০১৮ সালের মধ্যে চালুর সিদ্ধান্ত হয়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০২১ সালের ডিসেম্বরেও সেটি হয়নি। জানা গেছে, ২০১১ সালে প্রথম প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধনের পর পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এ প্রকল্পটি সংশোধন না করে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সেতু বিভাগ জানিয়েছে, প্রকল্পের মূল ডিপিপিতে ১ হাজার ৫৩০ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা ছিল ১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। কিন্তু মোট ভূমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে ২ হাজার ৬৯৮ হেক্টর। অতিরিক্ত জমি বাবদ মোট ব্যয় প্রয়োজন হয়েছে ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। এসব কারণেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে ভূমিসহ অধিগ্রহণ বাবদ আরও এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হয়েছিল। করোনা, বন্যা, পাইলিং জটিলতাসহ নানা কারণে সেতুটির নির্মাণ সময় ৫ দফা বেড়েছে।
একনজরে সেতুর আদ্যোপান্ত
প্রকল্পের নাম: পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। প্রকল্পের অবস্থান: রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। দেশের মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলায় প্রকল্পের অবস্থান। সেতুর উত্তর প্রান্তে মাওয়া, লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ এবং দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরীয়তপুর, শিবচর ও মাদারীপুর। যেভাবে শুরু হয়েছে- ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০৪ সালের জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা করা হয়।
একনেক সভায় অনুমোদন : ২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ে। ২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আবারও আট হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সর্বশেষ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পুরো টাকাই সরকারি অর্থায়ন।
প্রকল্পের মেয়াদ : ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩০ জুন ২০২৩। পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া: পদ্মা সেতু নির্মাণে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ অঙ্গীকার করেছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগ তুলে এই অঙ্গীকার থেকে সংস্থাটি সরে যায়। এ ধরনের কাজের শর্ত অনুযায়ী মূল ঋণদাতা চলে গেলে চলে যায় অন্যরাও। কাজেই একে একে এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও চলে যায়। এরপর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
ঋণচুক্তি অনুযায়ী, আগামী অর্থবছর থেকে ৩৫ বছরে অর্থ বিভাগের ঋণ পরিশোধ করা হবে। আর সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধের শিডিউল অনুযায়ী, প্রতি অর্থবছরে প্রায় সর্বনিম্ন ৮২৬ কোটি থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হবে। ত্রৈমাসিক হিসেবে প্রতি বছর চারটি ও ৩৫ বছরে মোট ১৪০টি কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করা হবে। এক্ষেত্রে প্রতি কিস্তি-পরবর্তী ঋণ স্থিতির ওপর সুদ হিসাব করা হয়েছে। এছাড়া সেতু কর্তৃপক্ষ চাইলে সুদসহ অর্থ অগ্রিমও পরিশোধ করতে পারবে। তবে কোনো কারণে একটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে, তা পরবর্তী কিস্তির সঙ্গে বকেয়াসহ পরিশোধ করতে হবে।
প্রকল্পের মোট ব্যয়: ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। মূল সেতুর ঠিকাদার: পদ্মা সেতু নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির নাম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের আওতাধীন চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি। মূল চুক্তিমূল্য: ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। কাজের মূল সময়সীমা: ৪৮ মাস। বর্ধিত সময় ৪৩ মাস। কাজ সমাপ্তির পুনর্নির্ধারিত তারিখ: ৩০ জুন, ২০২২।
নকশা: আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমের (অঊঈঙগ) নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল। ধরন: পদ্মা সেতুর ধরন দ্বিতলবিশিষ্ট। প্রধান উপকরণ: কংক্রিট ও স্টিল। রক্ষণাবেক্ষণ: বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। দৈর্ঘ্য: পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।
প্রস্থ: পদ্মা সেতুর প্রস্থ হবে ৭২ ফুট, এতে থাকবে চার লেনের সড়ক। মাঝখানে রোড ডিভাইডার। পানির স্তর থেকে উচ্চতা: ৬০ ফুট। পাইলিং গভীরতা: ৩৮৩ ফুট। মোট পিলার: ৪২টি। মোট পাইলিং: ২৮৬টি। সংযোগ সড়ক: পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার। মোট লোকবল: পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছে প্রায় চার হাজার মানুষ। নদীশাসন: প্রকল্প এলাকায় প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে মাওয়া এলাকায় ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং বাকি ১২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার জাজিরা এলাকায়। ঠিকাদারের নাম: সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড চায়না। ভূমি অধিগ্রহণ: ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ২ হাজার ৬৯৩ দশমিক ২১ হেক্টর। অ্যাপ্রোচ রোড: জাজিরা ও মাওয়া। সেতু পাড়ে বৃক্ষরোপণ: লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৪ লক্ষাধিক। পদ্মা সেতু জাদুঘর স্থাপন: পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় ‘পদ্মা সেতু জাদুঘর প্রতিষ্ঠা’র জন্য নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ চলমান।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।