আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরা: চামড়ার দাম পাওয়া নিয়ে এবারও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব জিনিসের দাম বাড়লেও কমেছে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম। গত দশ বছরের প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি প্রায় শূন্যেরে কোটায় নেমে এসেছে। বাংলাদেশের চামড়াশিল্প পরিবেশবান্ধব নয় এমন অভিযোগে বিশ্বের খ্যাতনামা কম্পানিগুলো এ দেশ থেকে চামড়া নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে গত তিন বছর ধরে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত ‘আত্মঘাতী’ বলে মন্তব্য করেছে ট্যানারি মালিকরা। যে সব দেশে কাঁচা চামড়া রপ্তানির কথা ছিল সেসব দেশ কাঁচা চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখায়নি। ফলে শুধু মাত্র বাংলাদেশ থেকে কাঁচা চামড়া রপ্তানি করতে হয়েছে ভারতে । ব্যবসায়ীরা বলছে ভারতে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দেওয়াতে কুরবাণির মৌসুমে বিপুল পরিমানে কাঁচা চামড়া পাঁচার হচ্ছে। সবশেষ এবারে ঈদুল আজহায় চামড়ার ন্যায্যমূল্য দূরের কথা, চামড়া বিক্রির জন্য অনেক এলাকায় ক্রেতারই খোঁজে পাওয়া কঠিন হবে। এবছরও বিশেষ কোনো সুখবর নেই কোরবানিদাতাদের জন্য। এমনটাই দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। ট্যানারি মালিক ও কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা যায়।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছরই কোরবানির সময়টিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৮৪ কিলোমিটার সীমান্তের কমপক্ষে ১১টি চোরাচালান পয়েন্ট দিয়ে বিপুল পরিমাণ চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যায়। এসব পয়েন্টে প্রায় অর্ধশতাধিক চোরাকারবারি সক্রিয় রয়েছে চামড়া পাচারের কাজে। চামড়া পাচারের সঙ্গে যশোরে ১৫ জন, সাতক্ষীরার ১৮, কুষ্টিয়ার ছয়জন, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার আটজন এবং ঝিনাইদহ জেলার সাতজন প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছে । ভারতে চামড়ার দাম অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় ও বাংলাদেশের পশুর চামড়ার সেখানে ভাল চাহিদা থাকার কারণে সাধারণভাবে বছরজুড়েই এ পাচারের ঘটনা ঘটে থাকে। অন্যদিকে কোরবানির এ সময়টিতে পাওয়া বিপুল পরিমাণ চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থাও দেশের সব স্থানে নেই। এদিকে কোরবানির পশুর চামড়া ভারতে পাচার রোধে দেশের সীমান্তে সতর্কতা জারি করেছে প্রশাসন। সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে সীমান্ত জেলার পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে। সীমান্তবর্তী জেলায় নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলার প্রশাসনকে সভা করে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলাতেই রয়েছে চামড়ার হাট। তবে সব থেকে বেশি ট্যানারি রয়েছে যশোর জেলায়। যশোরের রামনগর, রাজারহাটের চামড়া হাটে যশোরসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ছাড়াও গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা চামড়ার বিপণন হয়ে থাকে। এ হাট দুটিতে কোরবানির সময়ে প্রায় ৬০-৭০ হাজার পিস চামড়া বেচাকেনা হয়ে থাকে। এ চামড়ার প্রায় ৮০ শতাংশই ঈদ পরবর্তী কয়েক মাস ধরে ভারতে পাচার হয়ে চলে যায় বলে সূত্র জানায়।
চামড়া ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে দেশে চামড়ার দাম নির্ধারণ করার। কিন্তু সেটা হয়না। এ বছরও চামড়ার দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চামড়া পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভরতের পশ্চিমবঙ্গের শক্তিশালী একটি চক্র জড়িত রয়েছে। লবণযুক্ত গরুর কাঁচা চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ঢাকার বাইরের নির্ধারণ, প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া নির্ধারণ যা করা হয়েছে তা গ্রামে গ্রামে ঘুরে চামড়া কিনলে লাভ হবে না। আর সে কারণেই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ভারতে ব্যবসা খুঁজে নেন। ঈদ মৌসুমে নগদ টাকায় চামড়া কিনতে হয়। সেগুলো বড় ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে মাসের পর মাসও টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। অন্যদিকে ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া বিক্রি করলে বেশি লাভ হয় ও নগদে টাকা পাওয়া যায়। ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য গরুর চামড়া জোগাড় করা কঠিন। তাই তারা প্রতিবছরই বাংলাদেশের এ সময়টির অপেক্ষায় থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা এদেশের অনেক ব্যবসায়ীকে অগ্রিম টাকাও দিয়ে রাখেন। যাদের মধ্যে কেবল সীমান্ত এলাকার নয়, ঢাকার কিছু ব্যবসায়ীও রয়েছেন।
চামড়া ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন, গ্রাম ও পাড়া মহল্লায় ঘুরে সরকারের নির্ধারিত মূল্যে চামড়া কিনে ট্যানারি মালিকদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয় তারা। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা সরকারের নির্ধারিত দাম দেয়না বলে অভিযোগ তাদের। চামড়ার দাম কম। তা ছাড়া ঢাকার মালিকরা বছরের পর বছর পাওনা টাকা শোধ না করায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চামড়া ক্রয় করে না। ফলে চামড়ার আড়তে খেটে খাওয়া মানুষগুলো আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে। চামড়ার পাচার রোধকল্পে প্রকৃত মূল্য প্রাপ্তির পাশাপাশি চামড়া শিল্পকে সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে, কাঁচা চামড়া বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা করতে হবে বলে চামড়া ব্যবসায়ীরা মনে করেন বলে সীমান্ত এলাকার প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে সীমান্ত এলাকার প্রশাসন চামড়া পাচার রোধ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে পুলিশ প্রশাসনের দাবি।
তবে এবার চামড়ার দাম কিছুটা বাড়বে বলে আশা করছে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। বুধবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাঁচা চামড়ার গুণগত মান ঠিক রাখা, লবণের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে এক মতবিনিময় সভায় সংগঠনের সভাপতি মো. আফতাব খান বলেন, এবার চামড়ার দাম একটু বাড়বে। যদি লবণ ব্যবসায়ীরা কোনো সংকট তৈরি না করেন।