আবু সাইদ বিশ্বাস: ১০০ মিটার স্প্রিটে দৌড়িয়ে দ্রুততম মানবীর মুকুট অর্জন করেছে সাতক্ষীরার মেয়ে শিরিন আক্তার। তার বাড়িতে চলছে আনন্দ উৎসব। জাতীয় গ্রীষ্মকালীন অ্যাথলেটিক্সের ১০০ মিটার স্প্রিট সুমাইয়া দেওয়ানকে হারিয়ে দ্রুততম মানবীর মুকুট পুনরুদ্ধার করে সাতক্ষীরার মেয়ে শিরিন আক্তার। এ নিয়ে ১৩ বার ১০০ মিটার জিতলেন শিরিন। সময় নিয়েছেন ১১.৯৫ সেকেন্ড। ইলেকট্রনিক বোর্ডে এটি মেয়েদের ১০০ মিটারে নতুন জাতীয় রেকর্ড। আগের রেকর্ডও ছিল শিরিনের। ২০১৬ সালে গুয়াহাটি এসএ গেমসে করেন ১১.৯৯। অ্যাথলেটিকস ও সাঁতারের জাতীয় প্রতিযোগিতা মানেই টাইমিং নিয়ে প্রশ্ন। গত জাতীয় প্রতিযোগিতার মতো এই প্রতিযোগিতাও হয়েছে ইলেকট্রনিক টাইমিংয়ে। দ্রুততম মানবী শিরিন তার ১০০ মিটার ইভেন্টে সেরা টাইমিং করেছেন। এই ইভেন্টে আগের সেরা টাইমিং ছিলো ১১.৯৯। সেটা ছিলো ২০১৬ সালে গৌহাটি সাফ গেমসে। এবারের সামারে তার টাইমিং তিনি করেছেন ১১.৯৫। দ্বিতীয় হওয়া সুমাইয়া দেওয়ানের টাইমিং ১২.০৯
আঙ্গুরা বেগম এখন আর তার মেয়ে শিরিনকে অকর্মা বলেন না। অথচ, ‘তুই অকর্মার ঢেঁকি, তোকে দিয়ে কিছু হবে না। অমুকের মেয়ের পা ধোয়া পানি খা গিয়ে’- মায়ের এসব কথা শুনতে শুনতেই ছোটবেলার বেশিরভাগ সময় পার করেছেন সাতক্ষীর সদরের দহকোলা গ্রামের শিরিন আক্তার। যিনি ১৩ বছর ধরে দেশের দ্রুততম মানবীর খেতাব ধরে আছেন। বছরের পর বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় শিরিনের মা এখন বলেন, ‘তুই তো আমার সোনার মেয়ে।’
শেখ আবদুল মজিদ ও আঙ্গুরা বেগম দম্পতির কোনো ছেলে নেই। চার বোনের মধ্যে শিরিন দ্বিতীয়। বিকেএসপির সাবেক এই শিক্ষার্থী এখন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অ্যাথলেট। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান হলেও খেলার মাঠে দ্বিতীয় কমই হয়েছেন। প্রথম হওয়াটাই তার সবচেয়ে বড় নেশা। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো দেশের দ্রুততম মানবী হওয়ার পর আর পেছনে তাকাননি শিরিন। এক এক করে মোট ১৩ বার জিতেছেন মেয়েদের ১০০ মিটার স্প্রিটের স্বর্ণ। এছাড়াও তার অর্জনে আছে, ২০১২ সাল পর্যন্ত জুনিয়র অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম স্থান, এসএ গেমসে ২টি ব্রোঞ্জ, জুনিয়র এসএ গেমসেও ২টি ব্রোজ, ২০১৬ রিও অলিম্পিকে হিটে ৫ম স্থান, কমনওয়েলথ গেমসে অংশগ্রহণ। তার আশা আগামী ২০২৪ সালে প্যারিস অলিম্পিকে অংশগ্রহণকরে দেশের জন্য পদক নিয়ে আসবেন। ভবিষ্যৎতে স্পোর্টস সাইন্স’র উপর পিএইচডি করে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের হয়ে অ্যাথলেটিক্স খেলোয়াড় তৈরিতে ভূমিকা রাখবেন দেশসেরা এই দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার।
সাতক্ষীরা সদরের অজপাড়াগাঁয় দহাকুলা গ্রামে ১৯৯৪ সালে ১২ অক্টোবর এক দরিদ্র কৃষক শেখ আব্দুল মুজিদ ও আঙ্গরা খাতুন দম্পত্তির ঘরে জন্মগ্রহণ করে এই দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার। চার বোনের মধ্যে শিরিন দ্বিতীয়। ছোট বেলা থেকে দুরন্তপনা । দহাকুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় দুরন্তপনার সাক্ষী হয়ে যায় শিক্ষক এবং তার পরিবারের কাছে। সেই প্রথম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে অর্জন করতেন পুরস্কার। তারপর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয় পৌর শহরতলীর কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
সেখানে পড়া অবস্থায় ২০০৭ সালে বিকেএসপি থেকে সাতক্ষীরায় খেলোয়ায় বাছাই কর্মসূচিতে শিরিন আক্তার সিলেক্ট হয়। বিকেএসপিতে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে এসএসসি, এইচএসসি শেষ করে, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স, উত্তরা ইউনিভার্সিটি থেকে বিপিএড, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পোর্টস সাইন্স’র উপর এমএস করছেন এই দ্রুততম মানবী শিরিন। বর্তমানে শিরিন আক্তার তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার আয়ের উপর বৃদ্ধ পিতা-মাতাসহ দুই বোনের পড়াশুনার খরচ নির্বাহ করে। একটি বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তার পরিবার এখন ৫জনে। তার দুইবোনও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস সাইন্স’র উপর পড়ছেন।
দেশসেরা দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার তার এই অর্জনের জন্য বিকেএসপি, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, আমার কোচ সহ সবার কাছে কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যৎতে স্পোর্টস সাইন্স’র উপর জার্মানী অথবা আমেরিকায় পিএইচডি করে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের হয়ে অ্যাথলেটিক্স খেলোয়াড় তৈরিতে ভূমিকা রাখবেন দেশসেরা এই দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার।
তিনি বলেন আমি চাই আরও সামনে এগিয়ে যেতে। আমার লক্ষ্য ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিক। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে আইডল হিসেবে মানেন তিনি। এছাড়াও তিনি তার নিজের জেলা সাতক্ষীরাতেও অ্যাথলেটিক্স খেলোয়াড় তৈরিতে ভূমিকা রাখবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এজন্য তিনি সকলের কাছে দোয়া ও আশীর্বাদ চেয়েছেন।
আবু সাইদ বিশ্বাস
সাতক্ষীরা
২৪/৯/২২