সাতক্ষীরায় শিশু বৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে: কেটে ফেলা হচ্ছে শিশুদের জরায়ু

আবু সাইদ বিশ্বাস,  ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরাঃ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভুগতে থাকা বিশ্বের প্রথম সারির অরক্ষিত দেশের একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার ৮৭টি উপজেলার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল সরাসরি ভোগ করছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুরা। সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারাবিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১৭ কোটি ৫০ লাখ শিশু ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এসব রোগের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে উপকূলীয় শিশুরা। এ থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস পালন করে আসছে। এবছর শিশুর অধিকার, সুরক্ষা এবং শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্ট সকলকে অধিকতর উদ্যোগী ও সচেতন করার লক্ষ্যে ৪ থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত পালন করা হচ্ছে শিশু অধিকার সপ্তাহ।
ইউনিসেফের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা ৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। উপকূলের শিশুদের জীবন দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে হাজার হাজার পরিবার শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা উপকূলের বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে জীবনের তাগিদে বাধ্য হচ্ছে শহরে আসতে। উপকূলে মানুষের কাজ কমে যাচ্ছে, জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, অন্যসব জেলায় জনসংখ্যা বাড়লেও উপকূলের জেলাগুলোতে বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পেয়ে উল্টো কমে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলের জীবনব্যবস্থায় চরম বৈষম্য তৈরি করছে। দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিশুরা যে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হচ্ছে উপকূলের শিশুরা সেসব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জলবায়ু সমস্যাগ্রস্থ পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের পেছনে বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে উপকূলের শিশুরা অপুষ্টি নিয়ে বড় হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি সংকটসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উপকূলের হাজার হাজার শিশু রোগগ্রস্থ হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা উপকূলের বহু পরিবার তাদের শিশু সন্তানদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। অনেক পরিবার তাদের মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ খারাপ জেনেও শুধু বেঁচে থাকার জন্য পরিবারগুলো এসব সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে! জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে শহরে পাড়ি জমানো পরিবারগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। শহরের বস্তিতে কিংবা রেললাইনে ঠাঁই নেওয়া এসব পরিবারের শিশুরা তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলছে। পড়ালেখা বাদ দিয়ে শিশুরা দোকান, কারখানাসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিচ্ছে। শহরে এসে অনেকে স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও জলবায়ু উদ্বাস্তু বেশিরভাগ শিশু শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার কাছে হার মেনে বিপথে চলে যাচ্ছে।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সেই ভবিষ্যৎ শিশুদের জীবন এখন এলোমেলো। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, সমুদ্রপৃৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, তাপদাহ, নদীভাঙ্গনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় জীবনব্যবস্থার ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে । বিশেজ্ঞরা বলছে, লবণ পানি খাওয়া ও স্নান করার কাজে ব্যবহার করায় শিশুদের চর্মরোগ ও বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার দরিদ্র পরিবারের শিশুদের ফুসকুড়ি, খোসপাঁচড়া, চুলকানির মতো সাধারণ সমস্যা লেগেই আছে। লবণ পানি পান করার কারণে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগতে ভুগতে শিশুর মৃত্যুু পর্যন্ত হচ্ছে।
পনেরো বছর বয়সেই জরায়ুর সমস্যা দেখা দেয় সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নের খৈলপতুয়া গ্রামের বাসিন্দা হোসনে আরার; সঙ্গে চর্মরোগ তো ছিলই। এই অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে কাটে তার তেত্রিশটি বছর। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শ নেন কয়েকবার। তবুও মেলেনি কোনো প্রতিকার। সম্প্রতি কয়েক দফা পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, লবণাক্ত পানির কারণেই তার এসব সমস্যা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হবে তাকে।
হোসনে আরা বলেন, ‘ছোট বয়স থাইক্কাই গাইনি সমস্যায় ভুগছি। ডাক্তারদের কাছে গেছিলাম। তারা বললেন, লবণাক্ত পানি যেন ব্যবহার না করি, কুনু সময় যেন না খাই। কিন্তু এই পানি ছাড়া আমাদের গ্রামে তো অন্য কোনো উপায় নাই। এখন ডাক্তার বলছেন, জরায়ু কাইটা ফালাই দিতে হবে।’শুধু হোসনে আরা নন, লবণাক্ত পানির কারণে সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার শিশুরা চর্মরোগ, লিউকোরিয়া, রক্তশূন্যতা, আমাশয়, পুষ্টিহীনতাসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগেও ভুগছে। অনেক শিশু ছোট থেকেই লম্বা হয় না। মাথা ও পেট মোটা হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হতে পারে। ফলে সরকারে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার শিশুদের জন্য আলাদা পরিকল্পনা ও বরাদ্দ রাখতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে জলবায়ু ফান্ডের ফান্ডের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা এখনও বন্ধ হয়নি। বেশ কয়েকটি প্রকল্পে অনিয়ম দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্থরা। এখনই জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগামী ২০ বছরে শতকরা ৩২০ ভাগ বাড়বে। পাশাপাশি বাড়বে শিশুমৃত্যুর হারও।

Check Also

আশাশুনি সদর ইউনিয়ন জামায়াতের ৮টি ওয়ার্ডে আংশিক কমিটি গঠন

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি প্রতিনিধি।।বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আশাশুনি সদর ইউনিয়নের ৮টি ওয়ার্ডে আংশিক কমিটি গঠন করা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।