আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরাঃ বৈশ্বিক উষ্ণতায় বৈরী আবহাওয়া, দীর্ঘ খরা ও বিদ্যুৎ সংকট, সার-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে চলতি মৌসুমের আমন ফসল। এতে উৎপাদন ও মজুত কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উৎপাদন কমে গেলে বাজারে চালের দাম বাড়বে হু হু করে। মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিহীন বর্ষায় আমন আবাদ সঙ্কটের মুখে ফেলে দেয়। অন্যান্য বছর যে সময় পুরো দমে আমন আবাদ চলে এ বছর সেই একই সময় আমন আবাদ দূরের কথা, আমনের বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি। অনেক এলাকায় বৃষ্টির অভাবে আমনের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে যায়। কোথাও কোথাও কৃষক সেচ দিয়ে আমনের চারা রোপণের চেষ্টা করে। কিন্তু খরচ বেশি হওয়ার ভয়ে অনেক কৃষকই আমন আবাদ থেকে দূরে থাকে। ফলে এই অস্থির আবহাওয়ায় এ বছর আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা কতটা অর্জন করা যাবে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রগুলো তেমন পানি সরবরাহ করতে পারছে না। এরপর সার ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে। চলতি মৌসুমে এক লাফেই ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। আর সারের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৮ শতাংশ। কৃষি উৎপাদনের সবচেয়ে মৌলিক দুটি পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে এ খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা।
২০০৭-০৮ অর্থবছরে পরপর দুটি প্রলয়ংকরী বন্যা ও সাইক্লোন সিডর আমন ফসলের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছিল। সরকারি হিসাব মতে ১ কোটি ৩০ লাখ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ওই মৌসুমে উৎপাদিত আমনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৯৬ লাখ টনে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও উপর্যুপরি বন্যার কারণে আমন উৎপাদন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারি ভাষ্যমতে, ২০২২ সালের বন্যায় সারা দেশের ৩৭টি জেলায় আমন ফসল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারি হিসাবে এ বন্যায় ১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়।
দক্ষিণাঞ্চলের অধিভুক্ত খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫ লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ হেক্টর। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই অঞ্চলে রোপা আমন (হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের) বীজতলার লক্ষ্যমাত্রা ১৭ হাজার ৩৫২ হেক্টর। অপরদিকে, চলতি অর্থবছরে এ অঞ্চলে রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৯৯ হাজার ১১০ হেক্টর। কৃষি খাতে (শস্য উপখাত, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য উপখাত এবং বন উপখাত নিয়ে গঠিত) প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস চাল উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হারকে প্রভাবিত করেছে। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, কৃষিতে এক সময়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধিহার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে তলানিতে ঠেকেছে। সরকারি তথ্য মোতাবেক, ২০০৯-১০ অর্থবছরের ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধিহার ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ১৭ শতাংশে, যা বিবিএসের সাময়িক প্রাক্কলন অনুযায়ী হ্রাস পেয়ে (২০২১-২২) অর্থবছরে ২ দশমিক ২০ শতাংশে দাড়াঁয়। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে চাল উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থানে ছিল আমন। ওই বছর আমন ও বোরোর উৎপাদন দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮৮ লাখ ৫০ হাজার এবং ৮১ লাখ ৩৭ হাজার টন। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে আমন ও বোরোর উৎপাদন দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭৭ লাখ ৩৬ হাজার এবং ১ কোটি ৫ লাখ ৫২ হাজার টন (সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০০৫)।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১ অনুযায়ী ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ অর্থবছরগুলোয় যখন বোরো চালের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১ কোটি ৮০ লাখ ১৬ হাজার, ১ কোটি ৯৫ লাখ ৭৬ হাজার, ২ কোটি ৩ লাখ ৮৯ হাজার এবং ২ কোটি ১ লাখ ৮১ হাজার টন, তখন আমনের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৫৬ হাজার, ১ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার, ১ কোটি ৪০ লাখ ৫৫ হাজার এবং ১ কোটি ৫৫ লাখ ২ হাজার টন। খরার কারণে চলতি অর্থবছরে আমন আবাদের শুরুটা ভালো হয়নি। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, গত ৪১ বছরের মধ্যে এ বছরের জুলাই মাসে (১৭ আষাঢ়-১৬ শ্রাবণ) দেশে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। কৃষকরা জানান, আমন রোপণের জন্য এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই বীজতলা তৈরির পর মধ্যজুন থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে আমনের চারা রোপণের সঠিক সময়। এরপর আমন রোপণ করা গেলেও তাতে ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বেশি হয়। যে কারণে এবছর চলতি মৌসুমে আমন ধানে পোকার আক্রমণ বেশি দেখা দিয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমের জন্য জেলায় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৯ হাজার ৯১০ হেক্টর পরিমাণ জমিতে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর, কলারোয়ায় ১১ হাজার ৯০০, তালায় ৯ হাজার ৬০৫, দেবহাটায় ৫ হাজার ৫০৫, কালীগঞ্জে ১৭ হাজার ৫০০, আশাশুনিতে ৯ হাজার ২৬০ এবং শ্যামনগর উপজেলায় ১৬ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড.মোঃ জামাল উদ্দীন জানান, চলতি মৌসুমে প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হচ্ছে। তিনি বলেন মৌসুমি বৃষ্টি না হওয়ার কারণে আমন আবাদের শুরুতে কিছুটা অনিশ্চিয়তা দেখা দিলেও উৎপাদনের লক্ষ মাত্রা অর্জিত হবে। যে কারণে জেলা কৃষি খামার বাড়ির পক্ষ থেকে আমন চাষিদের বার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।