ধান নিয়ে দুশ্চিন্তা, খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ

প্রধান খাদ্যগুলো নিজেদের উৎপাদন করতে হবে
♦ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বেশি জোর দিতে হবে
♦ আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে
♦ খাদ্যশস্য সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে হবে

চলতি বছর ধান উৎপাদন কমবে। করোনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে দরিদ্র মানুষ বাড়ছে। ফলে বাড়ছে ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা। এসব তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে সাবধানতার পরামর্শ দিয়েছে তিনটি বৈশ্বিক সংস্থা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে এবং খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানের যদি আরো অবনমন হয় তাহলে দেশে খাদ্যসংকট তৈরি হতে পারে। তাই দেশে প্রধান খাদ্যগুলো নিজেদেরই উৎপাদনে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বেশি জোর দিতে হবে। বিশ্ববাজার থেকে আমদানির ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। খাদ্যশস্য সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়; ভালো উৎপাদন, উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’।

খাদ্যসংকট ও ক্ষুধার বর্তমান পরিস্থিতি তৈরির পেছনে বেশ কিছু কারণ উঠে এসেছে তিন সংস্থার প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে চাপে পড়েছে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা। যুদ্ধের কারণে খাদ্য বাণিজ্যে বড় বাধা তৈরি হয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় সরবরাহ সংকট হচ্ছে। ফলে বৈশ্বিক খাদ্যের সহজলভ্যতা কমছে। জ্বালানিসংকট আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারে বড় প্রভাব ফেলছে। সার ও কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা কিছুটা ঝুঁকিতে থাকবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অবশ্যই সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক যোগাযোগ সুদৃঢ় করতে হবে।

আয়ারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং জার্মানভিত্তিক ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ যৌথভাবে প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) আট ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২২ সালে ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪-তে নেমে এসেছে। এই সূচকে বাংলাদেশ মাঝারি ক্ষুধার ঝুঁকিতে রয়েছে বলা হয়েছে। তিন বছর ধরে এই সূচকে অবনমন হচ্ছে বাংলাদেশের।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০২২-এর সূচকে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম। আর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ক্রপ প্রসপেক্টস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশন শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৪৫টি দেশে ঘাটতিজনিত উচ্চ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা রয়েছে। এই তালিকায় এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

এ বিষয়ে সাবেক খাদ্যসচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কয়েকটি সূচকে আমরা পিছিয়ে গেছি বিষয়টা এমন নয়, আমাদের ক্যাটাগরি অবস্থানও অবনমন হয়েছে। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আমাদের যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কেন এই অবনমন হলো সেটি পর্যালোচনা করে সেই অনুসারে পদক্ষেপ নিতে হবে। ’

উচ্চ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ : এফএও

বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সেখানে উচ্চ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে থাকা ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। গত মাসে প্রকাশিত ক্রপ প্রসপেক্টস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশন শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৪৫টি দেশে ঘাটতিজনিত মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশেরই ৯টি দেশ রয়েছে। বাংলাদেশসহ তিনটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ার।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতির বিষয়ে প্রক্ষেপণ করা হয়। তাতে বলা হয়, চলতি বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য উৎপাদন কমবে ২.১ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশের ধান, গম ও অনান্য দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমবে ০.৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি কমবে ধানের উৎপাদন।

গত ২০২১ সালে দেশে ধান, দানাদার শস্য ও গমের উৎপাদন হয়েছিল ছয় কোটি ২৬ লাখ টন। চলতি বছর উৎপাদন হবে ছয় কোটি ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে ধানের উৎপাদন হবে পাঁচ কোটি ৬৪ লাখ টন, যা গত বছর ছিল পাঁচ কোটি ৬৮ লাখ টন। ফলে চলতি বছরে ধানের উৎপাদন কমবে চার লাখ টন। এ ছাড়া গমের উৎপাদন এক লাখ টন বৃদ্ধি পেয়ে ১২ লাখ টনে উন্নীত হবে। অন্যদিকে অন্য দানা শস্যের উৎপাদন ৪৭ লাখ টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ৪৮ লাখ টনে উন্নীত হবে।

১১৩টি দেশের মধ্যে ৮০তম বাংলাদেশ : ইকোনমিস্ট

বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১৩টি দেশের মধ্যে লাওস ও পাকিস্তানের ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ‘গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০২২’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি তুলে ধরতে ২০১২ সাল থেকেই এই সূচক প্রকাশ করে আসছে ইআইইউ। চারটি মানদণ্ডের ওপর ভিত্তিতে করে ১০০ পয়েন্টের সূচকটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলো হলো ক্রয়ক্ষমতা, সহজলভ্য বা প্রাপ্তি, গুণগত মান ও নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক সম্পদ ও সহনশীলতা। এই সূচকের খাদ্যের ক্রয়ক্ষমতায় উপসূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। ১১৩টি দেশের মধ্যে ৮৭তম।

kalerkantho

ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় ধারাবাহিক অবনমন

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) চলতি বছর আট ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২২ সালে ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪-তে নেমে এসেছে। ২০২১ সালে ১১৭টি দেশের মধ্যে ৭৬তম ছিল। ২০২০ সালে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৫তম।

আয়ারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও জার্মানভিত্তিক ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ যৌথভাবে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২২ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। চলতি বছরের ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ ১৯.৬ স্কোর পেয়েছে। মূলত ১০ থেকে ১৯.৯ পয়েন্ট পেলে ওই দেশ ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধা আক্রান্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান ক্ষুধা মেটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে। দেশ দুটির অবস্থান যথাক্রমে ১০৭ ও ৯৯তম। এ দেশ দুটি ‘উচ্চ ক্ষুধায়’ আক্রান্ত দেশের তালিকায় রয়েছে।

মূলত কোনো দেশের স্কোর ২০ থেকে ৩৪.৯ হলে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশু মৃত্যুর হার এসব সূচককে বিবেচনায় নিয়ে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত, প্রতি ছয়জনের একজন শিশু বয়সের তুলনায় খর্বকায় ও কৃশকায়। এই সব কটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় তা কম। যে কারণে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে।

কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড সিইও ডমিনিক ম্যাক সরলি জানিয়েছেন, বিশ্বজুড়ে সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন ও কভিড-১৯ মহামারির সম্মিলিত প্রভাবের কারণে ক্ষুধা সূচকের অবনতি হচ্ছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সরবরাহ এবং খাদ্য, সার ও জ্বালানির মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ধরনের সংকট ধীরে ধীরে বিপর্যয়কর রূপ নিতে শুরু করেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে সারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে দানাদার খাদ্যের দাম ৩৭ শতাংশ, ভোজ্য তেলের দাম ৫৬ শতাংশ এবং মাংসের দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে।

২০০৮-২০০৯ সালে দেশে যেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল তিন কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টন, সেখানে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে তা বেড়ে চার কোটি ৭২ লাখ ৮৮ হাজার টন হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর সম্প্রতি একটি সেমিনারে জানিয়েছেন, গত দুটি মৌসুমে বিশেষ করে বোরো ও আউশ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে চাল উৎপাদন হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়েছিল। তাই চালের ও দানাদার খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে নানাভাবে পরামর্শ ও নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

আগামী বোরোতে সর্বোচ্চ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশের ১৪টি কৃষি অঞ্চলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা জানিয়ে শাহজাহান কবীর বলেন, ‘আশা করছি চলতি আমন ও বোরোতে ভালো ফলন হলে দেশে চাল নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।