উপকূলের লাখ লাখ শিশুর জীবন ও ভবিষ্যত হুমকির মুখেঃ

জলবায়ু পরিবর্তনে দারিদ্র্য ও স্থানচ্যুতি বেড়েছে দ্বিগুণঃ অপুষ্টিতে ভুগছে অর্ধেক শিশু
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ জলবায়ু সংকটের মারাত্মক প্রভাবে শৈশব হারাচ্ছে উপকূলের হাজারো শিশু। অভাবের তাড়নায় ০৭-১৫ বছর বয়সী শিশুরা এখন লেখা পড়া বাদ দিয়ে শ্রম বিক্রি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টি-অসময়ে বৃষ্টি, অতি গরম-দীর্ঘসময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রা, তীব্রঠান্ডা এবং বজ্রপাতের মতো দুর্যোগ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে পূর্বের তুলনায় এখন শিশুরা বেশি অসুস্থ থাকছে। আবার পরিবারের সঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে বহু শিশু অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছে। সেখানেও তারা চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে। সব মিলিয়ে শিশুদের বড় একটি সংখ্যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হতে পারে। ফলে সরকারে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার শিশুদের জন্য আলাদা পরিকল্পনা ও বরাদ্দ রাখতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে জলবায়ু ফান্ডের ফান্ডের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা এখনও বন্ধ হয়নি। বেশ কয়েকটি প্রকল্পে অনিয়ম দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
ইউনিসেফের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে। পরিবার, সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে ইউনিসেফ বলছে, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো বিরূপ আবহাওয়াজনিত ঘটনার সম্মিলন এবং সমুদ্রপৃষ্টর উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও নোনাপানির অনুপ্রবেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি ঘটনাসমূহ পরিবারগুলোকে আরও বেশি দারিদ্র্য ও স্থানচ্যুতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ, যা দরিদ্রবাংলাদেশিদের তাদের ঘরবাড়ি ও কমিউনিটি ফেলে অন্যত্র নতুন করে জীবন শুরুকরার চেষ্টার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অনেকে ঢাকা ও অন্য বড় শহরগুলোতে যাচ্ছে, যেখানে শিশুদের বিপজ্জনক শ্রম বা শিশুবিয়ের ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। গবেষণার কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ৬০ লাখ জলবায়ুজনিত অভিবাসী রয়েছে, যে সংখ্যাটি ২০৫০ সালের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলো তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, তখন শিশুরা তাদের শৈশব হারায়। শহরে তারা বিপদ ও বঞ্চনার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি শোষণ ও নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাইরে কাজে যেতে চাপের মুখে পড়ে।
সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে লবণাক্ত পানির কারণেই কঠিন ও জটিল রোগের মুখো মুখি হতে হচ্ছে শিশুদের। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হবে অনেকের। লবণাক্ত পানির কারণে সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার শিশুরা চর্মরোগ, লিউকোরিয়া, রক্তশূন্যতা, আমাশয়, পুষ্টিহীনতাসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগেও ভুগছে। অনেক শিশু ছোট থেকেই লম্বা হয় না। মাথা ও পেট মোটা হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কম বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; অন্ধকার এই যাত্রায় নিরাপদ থাকছে না গর্ভের শিশুও। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ধাক্কা সামলাতে সরকার প্রশমন আর অভিযোজনের নানামুখী পরিকল্পনা নিয়েছে। তার সঙ্গে শিশুদের জন্যও বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড রিফরেস্টেশন প্রজেক্ট (সিআরপিএআরপি) নিয়েছে সরকার। এতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু সহিষ্ণু প্রজাতি গাছ দিয়ে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে বনায়ন প্রকল্পে উপকারভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রভাবশালীদের নাম। টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোয় একদিকে আর্থিক অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে প্রশমন কার্যক্রমের বাস্তব কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নীতি ও আইন লপিঘত হওয়া সত্ত্বেও জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না।
শিশু বিশেজ্ঞরা বলছে, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে উপকূল অঞ্চলে চরম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। উপযুর্পরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করা পরিবারগুলো সংকটের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এছাড়াও দেশে মাত্রাতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করা পরিবারগুলো নতুন করে পড়েছে মহাসংকটে। সাধারণভাবে নিম্নমধ্যবিত্ত একটা পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তির সংখ্যা যদি মাত্র একজন হয় ও পরিবারের সদস্যসংখ্যা চার কিংবা তারও বেশি হয় সেসব পরিবারের সদস্যদের প্রতিদিন পরিপূর্ণ ক্যালরি গ্রহণ করা সম্ভব নাও হতে পারে! বয়সভেদে শিশুর ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা ঠিক না থাকলে সাধারণভাবে তা অপুষ্টি হিসেবে ধরা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের শিকার হয়ে উপকূলের হাজার হাজার পরিবার উঁচু বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছে। রয়েছে বাঁধ ভাঙার ভয়! ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে বাড়িঘর হারিয়ে দরিদ্রপরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব পরিবারের সদস্যরা শিশুদের পুষ্টি কী জিনিস তাই-ই হয়তো জানে না! আর জানলেও দারিদ্র্যের কবলে পড়া এসব পরিবারের শিশুরা পুষ্টি পায় না ন্যূনতম।
সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালীর বহু গ্রাম প্রতিদিন জোয়ারের সময় পানিতে তলিয়ে যায়। এসব গ্রাম জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করে নিজেরাই কোনোমতে জীবন নির্বাহ করছে।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি শিশু জলবায়ু পরিবর্তন বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী তীব্রতার অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ উপরের সারিতে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০২১) দেশের হাসপাতালগুলোয় তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে আসা তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ৭২ শতাংশের বেশি। পুরো দেশের অবস্থা যখন এই, তখন উপকূলের অবস্হা সহজে অনুধাবনযোগ্য। উপকূলের মানুষের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত যেমন বেশি তেমনি সেখানে কাজের ক্ষেত্র কম, দারিদ্র্য বেশি। উপকূলের শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছেও বেশি। সাধারণভাবে শিশুর অপুষ্টি খালি চোখে দেখা যায় না। দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি কিংবা তীব্রতর অপুষ্টির শিকার হলে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
উপকূলে শিশুর পুষ্টিহীনতা দূর করতে পরিবারের অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট খাতে বিশেষ বরাদ্দ রখার দাবী সংশিষ্টদের। উপকূলবাসীর জীবনমানের উন্নয়নে সামাজিক কর্মসূচির আওতায় ভিন্ন প্রকল্পে দারিদ্র্য দূর করার ব্যবস্থা রাখা দরকার। জলবায়ুগত সমস্যা যত কম হবে, দারিদ্র্য তত হ্রাস পাবে। শিশুর পুষ্টিহীনতা তত বেশি দূর হবে।

Check Also

সাংবাদিককে কারাদণ্ড- ক্ষমতার অপব্যবহার কি না সেটা তদন্ত শেষে ব্যবস্থা: তথ্য প্রতিমন্ত্রী

তথ্য চাওয়ায় শেরপুরের সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়ার ঘটনা ক্ষমতার অপব্যবহার কি না …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।