আবু সাইদ বিশ্বাস , সাতক্ষীরাঃ বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন সাফল্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন চিংড়ি সংশৃষ্টরা। উৎপাদন খরচ কম, উচ্চ ফলনশীল, সস্তা ও সহজলভ্য, খেতে ও বেশ সুস্বাদ হওয়ায় উপকূলে এই চিংড়ি চাষ বেড়েছে। বিশ্বের পুরো চিংড়ির বাজারও এখন ভেনামির দখলে। চিংড়ি চাষি ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রাসার অন্যতম খাত চিংড়ি শিল্পকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ‘ভেনামি’ চিংড়ি চাষের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র ভেনামিই পারে বাংলাদেশের চিংড়ি শিল্পের সম্প্রসারণ করে বিশ্ব বাজার ধরে রাখতে। অন্যথায় ধারাবাহিক অবনতিতে ‘খাদের কিনারায়’ এসে দাঁড়ানো চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
এদিকে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ চিংড়িশিল্পে নিয়ে এসেছে নতুন বিপ্লব। ভেনামি প্রজাতির চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ করার ফলে বৈশ্বিক চিংড়ি উৎপাদনের পরিমাণ ২০০৩ সালের ২ বিলিয়ন টন থেকে ২০২২ সালে ৯ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু অবাক করার বিষয়, প্রধান চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে বাণিজ্যিক ভেনামি চিংড়ির চাষের অনুমতি মিলল ২০২৩ সালের মার্চে মাচে। এরই মধ্যে পূরা বাজার হারালো বাংলাদেশ। ২০০০ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের চিংড়িশিল্প কাছাকাছি ছিল। ২০১৯ সালে ভারত চিংড়ি রপ্তানি করে আয় করে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা কিনা মোট বৈশ্বিক আয়ের ২৪ শতাংশ। ভারত এই বিপ্লব রচনা করেছে মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর চিংড়ির খামার থেকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর চিংড়ির খামার থেকে আয় করেছে শূন্য দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই খাতে আয় ছিল শূন্য দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
সাম্প্রতিক কালে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের আকাশচুম্বী উত্থানের পেছনে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ যুগান্তকরী অবদান রেখেছে। কয়েক বছর ট্রায়াল ও ঝুঁকি বিশ্লেষণের পর ভারত ২০০৯ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। এশিয়ার ১৫টি চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে ১৪টি দেশে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। ২০২১ সালে ১৩টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষামূলক ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে মৎস্য বিভাগ।
এদিকে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে বাগদা চিংড়ির গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩৪১ কেজি। সেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ‘ভেনামি’ চিংড়ির হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ৭ হাজার ১০২ কেজি। অর্থাৎ বাগদার তুলনায় ‘ভেনামি’র উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৬ হাজার ৭৬১ কেজি বেশি। যার প্রমাণ মিলেছে সাতক্ষীরা ও খুলনায় প্রথম বারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে চাষকৃত ‘ভেনামি’র উৎপাদনে।
সাতক্ষীরার ভেনামি চিংড়ি চাষের উদ্যোক্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ৩৩ বিলিয়ন ডলারের চিংড়ির বিশ্ববাজার। যার ৮০ ভাগই দখল করে নিয়েছে ভেনামি চিংড়ি। আমাদের লড়তে হয় মাত্র ২০ শতাংশ বাজারের জন্য। সেখানেও নানা প্রতিকূলতায় বাজারের দরপতনের কারণে চিংড়ির উৎপাদন ও রপ্তানিতে পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা। বিশ্ববাজারের চাহিদা বিবেচনায় দেশে এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে ভেনামি চিংড়ি চাষের কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, পাঁচ বছরে জেলায় রপ্তানিজাত চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৫২ হাজার ১৪৬ টন। এর মধ্যে বাগদা চিংড়ি এক লাখ ১৮ হাজার ৩০৮ টন। গলদা চিংড়ির পরিমাণ ৩৩ হাজার ৮৩৭ টনের মতো। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২৫ হাজার ৩৫৪ টন বাগদা ও ৬ হাজার ৩৪ টন গলদা চিংড়ি। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৬ হাজার ৪৮৫ টন বাগদা ও ৬ হাজার ১০৬ টন গলদা, ২০১৭-১৮ বাগদা ২০ হাজার ৯৪১ টন ও গলদা ৬ হাজার ৫২৫ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাগদা ২১ হাজার ৪৪১ টন ও গলদা ৬ হাজার ৫৪২ টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৮৭ টন বাগদা ও ৮ হাজার ৬৩০ টনের মতো চিংড়ি উৎপাদন হয়। উৎপাদিত এসব চিংড়ির রপ্তানিমূল্য ৭ হাজার ৬০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। জেলায় বছরে প্রায় ৬০ হাজার নিবন্ধিত ঘেরে চিংড়ি চাষ করা হয়।
চিংড়ি ব্যবসায়িরা জানান, গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাষ বছরে একবারের (চাষের সময় মারা গেলে দুবার) বেশি করা যায় না। আর ভেনামি চাষ করা যায় বছরে তিনবার। সাধারণ পুকুরে প্রতি হেক্টরে ৩০০-৪০০ কেজি বাগদা চিংড়ি উৎপাদন করা যায়। অন্যদিকে একই পরিমাণ জমিতে সাত-আট হাজার কেজি ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব। ভারতে ভেনামি চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষ থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পাঁচ বছর সময় লেগেছিল। বাংলাদেশে তিন বছরের মধ্যে সম্ভব।
সূত্রমতে, ফসলি জমিতে লবণাক্ততা, ক্ষয়িষ্ণু জীববৈচিত্র্য, সুন্দরবন ধ্বংস, প্রান্তিক কৃষকের বাস্তুচ্যুত হওয়া, হ্রাসকৃত ফসল উৎপাদনের মতো বড় মূল্যের বিনিময়ে লোনাপানির চিংড়ির দ্রুত সম্প্রসারণ হয়েছিল উপকূলে। ডলারের গন্ধে উপকূলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুনাফালোভী প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। সাদা সোনার হাতছানিতে গরিব ধানচাষির সাধের জমিটা রাতারাতি চলে গিয়েছিল লোনাপানির বাগদা চিংড়ি চাষের আওতায়। লবণে বিষাক্ত ধানি জমি চিংড়ি দস্যুকে দিয়ে দেশান্তরিত হয়েছিলেন অসংখ্য ভূমিহীন। অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণের অশুভ পরিণাম নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, গণমাধ্যম প্রচার করেছে নানা রঙের দুঃখ-সুখের খবর। দরিদ্র কৃষকের কলিজার টুকরা তিন ফসলি জমিতে লোনাপানির আগ্রাসন নিয়ে পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ কোনোভাবেই যথেষ্ট ছিল না। শেষ পর্যন্ত ডলার উপার্জন করা সাদা সোনাশিল্প প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় বিপন্ন কৃষি ও বিপর্যস্ত জীবিকায়নের মূল্যের বিনিময়ে। গড়ে ওঠে হ্যাচারি, প্রসেসিং প্ল্যান্ট, রপ্তানি কেন্দ্র। অগত্যা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় বিশাল জনগোষ্ঠীর। নীতিকৌশলে পরিবেশ রক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ নানা কথা লেখা থাকলেও, বাস্তবে দ্রুত মুনাফা অর্জন আর কাঁচা ডলারই প্রাধান্য পায়। কিন্তু হঠাৎ ভাবিয়ে তুলেছে চিংড়িশিল্পের ক্রমহ্রাসমান উৎপাদনশীলতা আর অনিশ্চিত গন্তব্য।
দ্রুত নীতিমালা বাস্তবায়নে বাণিজ্যিকভাবে ‘ভেনামি’ চিংড়ি চাষকে উন্মুক্ত করে রপ্তানির পদক্ষেপ নিতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সংশৃষ্টরা।