পবিত্র রমজানে  যাকাত ও ফিতরা আদায় 

বিলাল হোসেন মাহিনী: পবিত্র কুরআন ও সুন্নহে তথা ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সম্পদের সুষম বন্টনের লক্ষ্যে যাকাত ও ফিতরার প্রচলন করা হয়। যাতে ধন-সম্পদ শুধু ধনীদের মধ্যে ঘুরপাক না খায়। বরং পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমাদের (ধনীদের) সম্পদে রয়েছে অভাবী ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ (সুরা আল-জারিআত, আয়াত: ১৯) আমরা সহিহ হাদিস থেকে জানতে পাই, পবিত্র রমজানে এক টাকা দানে সত্তরের অধিক টাকা দানের সওয়াব পাওয়া যায়। তাই যাকাত, সদকা (দান) ও ফিতরা প্রদানের উত্তম সময় নিঃসন্দেহে এই রমজান মাস। আসুন যাকাত ও ফিতরা আদায়ের কতিপয় নিয়ম জেনে নিই।

পবিত্র কুরাআনের সুরা তাওবার ৬০ আয়াতে বলা হয়েছে, যাকাত নিম্নোক্ত ৮ শ্রেণির মানুষের মাঝে বন্টন করতে হবে। ১. ফকির ২. মিসকিন ৩.  জাকাত আদায়কর্মী ৪. নও মুসলিম ও অনুরাগী ৫. দাস-দাসী মুক্তি পণ ৬. ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি ৭. ইসলামের পথে জিহাদ (প্রচেষ্টা) কারী ৮. বিপদগ্রস্থ মুসাফির। এঁদের মাঝে যাকাতের অর্থ বন্টন করতে হবে। তবে বর্তমানে প্রচলিত শাড়ি-লুঙ্গি প্রদানের যে সিস্টেম চালু হয়েছে, তা ইসলামি অর্থনীতিতে বিশেষত: যাকাতের কর্মকৌশল বিরোধী। কেননা, যাকাতের উদ্দেশ্য হলো- স্বাবলম্বি করা। অর্থাৎ এ বছর যে ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া হবে, সে যেনো আগামিতে কারো কাছে হাত না পাতে। তার মানে, যাকাতের অর্থ দিয়ে অভাবী দরিদ্র ব্যক্তিকে আয়ের পথ বের করে দিতে হবে। প্রয়োজনে দশ জনের যাকাতের অর্থ একত্র করে একজন অভাবিকে দিতে হবে। যে যেনো ছোটখাটো ব্যবসা অথবা পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।

যাকাত দানকারী’র সম্পদের নিসাব (নির্ধারিত পরিমাণ) হলো, ৭ তোলা সোনা অথাব সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য অথবা সমমূল্যের নগদ অর্থ বা ব্যবসা পণ্য যদি বছরান্তে অবশিষ্ট থাকে, তবে তাঁর সম্পদের শতকরা আড়াই শতাংশ হিসাবে আল্লাহর নির্ধারিত খাতে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করতে হয়।
ইসলামে যাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রমজান মাসই জাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। ফলে এ সময় বিত্তবানেরা দান-সদকা ও জাকাত-ফিতরা প্রদানে উৎসাহিত হন। যাকাত প্রদানের ফলে ধনী গরিবের মাঝে পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে। তাই নবী করিম (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘জাকাত ইসলামের সেতু।’ (মুসলিম) রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি বস্তুর একটি যাকাত রয়েছে, আর মানুষের দেহের যাকাত হলো সাওম।’ (ইবনে মাজা)। আর যাকাত আদায়ে সম্পদ পবিত্র হয়। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত প্রদান করে, তার সম্পদের দোষ দূর হয়।’ যাকাত আদায় করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। ধনী লোকেরা যদি ঠিকমতো যাকাত আদায় করেন, তাহলে সমাজে কোনো অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, শিক্ষাহীন লোক থাকতে পারে না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো বান্দা যাকাত আদায় করে, তখন ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করে।’

ঈদের সালাতের পূর্বেই ফিতরা আদায় :

সদকাতুল ফিতর ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে আদায় করা সুন্নাত। রাসুল (সা.) লোকজন ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫০৯)। অবশ্য কোনো কোনো সাহাবি থেকে ঈদের কয়েকদিন পূর্বেও ফিতরা আদায়ের কথা প্রমাণিত আছে। যেমন- নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দুয়েক দিন পূর্বেই ফিতরা আদায় করে দিতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৬০৬)। সুতারাং ফিতরা রমজানের মধ্যে আদায় করলে অতিরিক্ত সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়। এতে গরিব অসহায় মানুষেরা ঈদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারেন সানন্দে। রোজা রাখতে গিয়ে যেসব ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে তা থেকে মুক্ত হতে ঈদের দিন সুবহে সাদেকের পর ঈদের নামাজের আগে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব।

সহিহ হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী ২ পরিমাপে ৫ জিনিস দিয়ে ফিতরা আদায় করা যায়। আর তাহলো গম, যব, কিসমিস, খেজুর, পনির। এগুলোর মধ্যে গমের পরিমাপ হলো অর্ধ সা আর বাকিগুলোর পরিমাপ এক সা। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী যে কোনো একটি দিয়ে এ ফিতরা আদায় করতে পারবেন। পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন কোনো স্বাধীন মুসলমানের কাছে জাকাতের নিসাব তথা সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণ কিংবা সাড়ে ৫২ তোলা রুপা অথবা তার সমমুল্যের নগদ অর্থ কারো কাছে থাকলেই ওই ব্যক্তির জন্য ফিতরা ওয়াজিব। বাড়ি-ঘর, আসবাবপত্র, স্থাবর সম্পদের মূল্য (যদি ব্যবসার জন্য না হয়) জাকাতের নিসাবের অন্তর্ভূক্ত নয় ৷ কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আসবাবপত্র,ঘর-বাড়ি ও স্থাবর সম্পদ, ভাড়া বাড়ি, মেশিনারীজ, কৃষিযন্ত্র ইত্যাদি (উপার্জনের জন্য না হলেও) এসবের মূল্যের হিসাবও ফিতরার নেসাবে অন্তর্ভূক্ত হবে। মহান আল্লাহ আমাদের প্রত্যেক ছাহেবে নেসাবকে যাকাত ও ফিতরা আদায়ের তৌফিক দান করুন। আমিন।

বিলাল হোসেন মাহিনী,
পরীক্ষক, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর, যশোর।
০১৯২২-৯৬৮২৯২

Please follow and like us:

Check Also

আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা হবে ৫ ঘণ্টার

২০২৫ সালে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।