পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণা আসতেই বাংলাদেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে মসলা জাতীয় এই পণ্যটির দাম কমতে শুরু করেছে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোমবার থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হওয়ার কথা। রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানায় কৃষি মন্ত্রণালয়।
এ ব্যাপারে সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পেঁয়াজের কেজি ৪৫ টাকার বেশি হওয়া উচিত না। কিন্তু বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে কেজি প্রতি দাম ৪৫ টাকার নিচে চলে আসবে বলে তিনি আশা করছেন।
কিন্তু আমদানিকৃত পেঁয়াজ বাজারে ঢোকার আগেই চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ভোগ্য পণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম এক রাতে ৩০ টাকা কমে গিয়েছে।
খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য মতে, রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ৯০ টাকা বিক্রি হলেও সন্ধ্যা পর পরই দাম কেজি প্রতি ৮০ টাকায় নেমে আসে।
আবার আজ সকালে দাম আরো কমে কেজি প্রতি ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আমদানি করা পেঁয়াজ বাজারে ঢুকতে শুরু করলে দাম আরো ২০ টাকার মতো কমবে বলে জানিয়েছেন খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম।
তিনি বলেন, ‘টিভিতে আমদানির ঘোষণা দিতেই বাজার নিম্নমুখী হয়ে গিয়েছে। অথচ আমদানির কোন পেঁয়াজ এখনো বাজারে ঢুকেনি।’
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। যে পেঁয়াজ মার্চ মাসে খুচরা বাজারে কেজি প্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। সেটি পরের মাসেই এক ধাক্কায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
কয়েক ধাপে দাম বেড়ে বর্তমানে খুচরা বাজারে ৯০ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা গিয়েছে।
সাধারণত পাইকারি বাজারে ৯০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হলে তা খুচরায় ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
গত দুই বছর পেঁয়াজ চাষে লোকসানের কারণে কৃষকরা কম উৎপাদন করেছে, এজন্য বাজারেও সরবরাহ কম বলে এখনো কোনো কোনো বিক্রেতা দাবি করছেন।
যদিও বাজারে পেঁয়াজের দাম রোববার পর্যন্ত এতো বেশি থাকার কারণ হিসেবে উৎপাদক বা কৃষকদের দুষছেন আড়তদাররা।
তাদের দাবি, উৎপাদক পর্যায়ে পেঁয়াজ মজুদ রাখার কারণে বাজারে এমন অস্থিরতা দেখা গিয়েছে।
কাশেম বলেন, ‘সরকার যখন বলল, পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকবে আর এলসি খুলতে দিবে না, তখনই উৎপাদকরা এটার সুযোগ নেয়। তারা বাজারে পেঁয়াজ ছাড়া বন্ধ করে দেয়। আজকে বেচব না কালকে আরেকটু দাম বাড়লে বেচব, এভাবে দাম বাড়ার অপেক্ষায় তারা বাজারে একটা সঙ্কট তৈরি করে। এজন্য এতো দাম বেড়েছে।’
তিনি জানান, রোববার পর্যন্ত চাহিদা ১০ ট্রাক থাকলেও বাজারে পেঁয়াজ এসেছে পাঁচ ট্রাকের মতো। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় আড়তদারদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এজন্য খুচরা বাজারেও দাম বাড়তি ছিল।
তবে রোববার সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ করে দাম কমে যাওয়ায় কৃষক ও আড়তদাররা বড় ধরণের লোকসানে পড়ার কথা জানান।
কাশেম বলেন, ‘আমদানির ঘোষণা আসতেই কৃষকরা গাড়ি ভর্তি করে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসছে। এখন এতো পেঁয়াজ যে তিন মাস খাওয়া যাবে। এরপর আমদানির পেয়াজও আসবে। তাই সামনে দাম আরো কমবে। এখন এত এত পেঁয়াজ এসেছে যে মোকামগুলো আর কিনছে না। এভাবে আমাদের দেশি পেঁয়াজ লোকসানে পড়ে গেল।’
তবে আড়তদারদের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রান্তিক পেঁয়াজ চাষীরা।
ফরিদপুরের কৃষক কলম চকদার জানান, ‘একজন পেঁয়াজ চাষী সবসময়ই চেষ্টা করে, সারা বছর ধরে তার উৎপাদন করা পেঁয়াজ বিক্রি করতে। এটা স্বাভাবিক। কারো জমিতে যদি ১০০ মণ পেঁয়াজ হয়। সে একেবারেই সব বিক্রি করে দেবে না। তবে বেশি লাভ করার জন্য পেঁয়াজ মজুদ করার অভিযোগ উঠেছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’
পেঁয়াজের ন্যায্য দাম নিশ্চিতে ও কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় গত ১৫ মার্চ পেয়াজ আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল সরকার।
পরদিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ থেকে দেশের সব বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এতে চাহিদার পুরোটা মেটাতে হয়েছে দেশি পেঁয়াজ দিয়ে।
সে সময় বলা হয়েছিল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সন্তোষজনক হওয়ায় আমদানির প্রয়োজন নেই।
কিন্তু বাস্তবে আমদানি বন্ধের ঘোষণা আসার পরপরই খুচরা ও পাইকারি বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম।
কিন্তু গত মাসে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়ার আভাস দিলে বাজারে এক লাফে কেজি প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে যায়। পরে আবার বাড়তে থাকে। এবারও আমদানির ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে দেখা গিয়েছে একই চিত্র।
এ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা মাঠ থেকে খবর পাচ্ছি যথেষ্ট পেঁয়াজ আছে। তারপরও কেন দাম কমছে না, এটা তো হওয়ার কথা না। দাম রিজনেবল না থাকলে আমদানি করতে হবে।’
পেঁয়াজের দামে এই ওঠানামা বাজার দরের কারণে নয়। বরং সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে হচ্ছে বলে ধারণা ক্রেতা ও ভোক্তা অধিকার সংগঠকদের।
ক্রেতাদের অভিযোগ বাজার মনিটরিংয়ের অভাবের কারণে দামে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকছে না।
মিরপুরের বাসিন্দা জাহানারা বেগম জানান, ‘বাজারে একেক দিন পেয়াজের দাম একেক রকম। দুই মাসে আগেও ছিল ৬০ টাকা, এরপর হল ৭০ টাকা, তারপর ৮০, ৯০। আজকে ১০০ টাকায় কিনলাম। কোনো পণ্যের দাম এভাবে বাড়তে পারে না। এটা পরিষ্কারভাবে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট। এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। কারণ ভোগান্তি শুধু আমাদের।’
এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার অ্যাসোসিয়েশনের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো ইন্সট্রুমেন্ট কাজ করছে না। পুরো বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। আড়তদার, মজুদদার ও ব্যবসায়ীরা এই সুযোগেই ক্রেতাদের জিম্মি করে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জায়গায় রাষ্ট্র নিজেই অসহায়।’
এবারে পেঁয়াজ আমদানির বিষয়ে চৌঠা জুন রোববার কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘পেঁয়াজ আমদানির বিষয়টি আমাদের জন্য উভয় সঙ্কটের মতো। পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিলে দাম অনেক কমে যায়, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়; পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আর আমদানি না করলে দাম বেড়ে যায়, ভোক্তাদের কষ্ট হয়। সেজন্য সবসময়ই আমরা চাষি, উৎপাদক, ভোক্তাসহ সবার স্বার্থ বিবেচনা করেই আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন।
পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এর মধ্যে কাজ শুরুর কথা জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত দুই বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ১০ লাখ টন বেড়েছে বলে জানানো হয়।
দুই বছরে আগে যেখানে উৎপাদন হতো ২৫ লাখ টনের মতো, ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়ে ৩৫ লাখ টন হয়েছে বলে জানা যায়।
পেঁয়াজের সংগ্রহ থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে বিভিন্ন ধাপে সেইসাথে প্রতিকূল আবহাওয়া, উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাব এমন নানা কারণে মোট উৎপাদনের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের মতো পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়।
সে হিসেবে গত বছর পেঁয়াজের ব্যবহারযোগ্য উৎপাদন হয়েছে ২৪ লাখ ৫৩ হাজার টন। বাকি চাহিদা মেটাতে ওই অর্থ বছরে পেঁয়াজ ছয় লাখ ৬৫ হাজার টন আমদানি হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর দুই লাখ ৪১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করার পর উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টন।
এবারও মোট উৎপাদনের ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। এরপরও প্রায় ১৮ লাখ টন মজুদ আছে বলে জানা যায়।
সে হিসেবে পেঁয়াজের সঙ্কট হওয়ার কথা নয়, তবুও দুই মাসের ব্যবধানে বাজারে পেঁয়াজের দাম এতটা বেড়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার অ্যাসোসিয়েশনের আলম মনে করেন, পেঁয়াজের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম থাকায় সরকারের উচিত ছিল আমদানি অব্যাহত রাখা।
তার মতে, সারা বছর চাহিদা অনুযায়ী আমদানি অব্যাহত রাখলে বাজারে এমন অস্থিরতা দেখা যেতো না, সরবরাহ স্বাভাবিক থাকত।
আলম বলেন, ‘আমদানি হঠাৎ বন্ধ করে, তারপর আবার চালু করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাজারকে অস্থির করে তোলা হচ্ছে। সরকারের অভিযান শুধুমাত্র খুচরা পর্যায়ে। কিন্তু পাইকারি ও আমদানি পর্যায়ে তাদের তেমন কোন তদারকি নেই।
বাজারের ওপর ব্যবসায়ীদের এই নিয়ন্ত্রণ ভেঙে তাদের শৃঙ্খলায় ফেরানো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছি আমদানিকৃত সব পণ্যের দামের তথ্য সামনে আনতে। কিন্তু তারা আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম নয়। আবার মাঠ পর্যায়ে ভোক্তা অধিকার রক্ষায় তারা তৎপর নয়।’
এর আগে কৃষিমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। সূত্র : বিবিসি