অনুপযোগী হচ্ছে উপকূলে বসবাস- ২০৫০ সাল নাগাদ তলিয়ে যাবার শংঙ্কা

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ অনুপযোগী হচ্ছে উপকূলে বসবাস। বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিস্তার লাভ করছে লবণাক্ততা। লবণাক্ত পানিতে বসবাস করার ফলে চর্মরোগ, কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগ লেগেই আছে। লবণাক্ত পানির জন্য নারীদের অকাল গর্ভপাত ঘটছে। ফলে বাড়ছে না জনসংখ্যা। কৃষিজমি নেই বললেই চলে। যা আছে তাতে ফসল হয় না। গো-খাদ্যের চরম সংকট। চিংড়ি চাষে দেখা দিয়েছে মন্দা। এখানে মানুষের বসবাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকা মুশকিল হচ্ছে উপকূলের কয়েক লাখ মানুষের। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার উন্নয়নে তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে না পারায় সব কিছু হারিয়ে অনত্র পাড়ি জমাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থরা।
সূত্রমতে ২১০০ সাল নাগাদ সমদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ দশমিক ১ মিটার বাড়তে পারে। আগের ধারণার চেয়ে যা ১০ সেন্টিমিটার বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালে মধ্যেই বিশ্বের কিছু এলাকা তলিয়ে যাবে। প্রতি বছর নিয়মিত আঘাত হানবে ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। নয়তো তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। এটি হলে বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। মহাসাগর ও পর্বতগুলোতে জমা থাকা বরফের স্তূপ ইতোমধ্যে গলা শুরু করেছে। সেগুলো আরও দ্রুত গলে পানির উচ্চতা ধারণার চেয়ে বেশি বেড়ে যাবে। ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অনেক অঞ্চল ডুবে যাবে। এতে উপকূলীয় ১৮ জেলা চরম আকারে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
দিনদিন পৃথিবীব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ছে। সে কারণে দুর্যোগও বাড়ছে। এসব দুর্যোগ বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানে। বহু মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে। এখানকার পুরুষরা তাদের সন্তান-স্ত্রীদের রেখে অন্য এলাকায় কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন। অনেকে এলাকায় ফিরছেন না। অনেক পুরুষ অন্য এলাকায় গিয়ে বিয়ে করে স্থায়ী হচ্ছেন। ফলে বোঝা টানতে হচ্ছে নারীদের। অনেক ক্ষেত্রে ওই পরিবারের নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। এখানে বসবাসের জন্য স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করলে কয়েক বছর পর এসব এলাকায় মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ উপকূলীয় এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা এখন সারা বছরব্যাপী চলমান। বিভিন্ন এলাকায় পরিকল্পিত এবং টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকার ফলে উপকূলবর্তী এলাকাসমূহ ক্রমান্বয়ে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এমন বাস্তবতায় জনমনের প্রশ্ন, বাঁচানো যাবে কী উপকূলের লোকালয়কে?
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনিস্টিটিউটের প্রকাশিত জার্নালের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৩৬ বছরে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ২ হাজার দশমিক ৮১ হেক্টরে। বৃদ্ধির হার শতকরা ২৬.৭ ভাগ। ১৯৭৩ সালে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ লাখ ৩৩ হাজার দশমিক ৪৫ হেক্টর। ২০০০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ২০ হাজার দশমিক ৭৫ হেক্টর। মাত্র এক যুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে ২০০৯ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার দশমিক ২৬ হেক্টর, অর্থাৎ ৯ বছরে বাড়ে ৩৫ হাজার দশমিক ৫১ হেক্টর ( বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ)। ২০২২সালে এসে তা দাঁড়ায় ১২ লাখ হেক্টরের কাছা কাছি।
আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আবু দাউদ ঢালী বলেন, আমার ইউনিয়নের একপাশে কপোতাক্ষ নদ আরেক পাশে খোলপেটুয়া নদী। দুই নদীর ২৫-৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অধিকাংশ এলাকা জরাজীর্ণ। প্রতিবছর নদীগুলোর পানি বাড়লেই লোকালয়ে ঢুকে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। বাঁঁধগুলো ষাটের দশকে তৈরি। এরপর নামমাত্র সংস্কার হয়েছে। দুর্যোগে ঘরবাড়ি ও মাছের ঘের ভেসে নিঃস্ব হয়ে যায় মানুষ। দুর্যোগের পর তারা কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে, পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় বসবাস করবে, কোথায় যাবে এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে। ফলে অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। এখানে আশ্রয়কেন্দ্র্র নেই। স্থায়ী বাঁধ না হওয়ায় প্রতিবছর ক্ষতিগস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে উপকূল।
জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে উপকূলীয় এলাকায়। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা ও মাটির লবণাক্ততা উপকূলের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীতের সময় অধিক শীত, গরমে প্রচন্ড গরম এবং বর্ষায় অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা বাড়ছে। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসে নদীভাঙন বাড়ছে। ফলে এসব এলাকার মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে।

শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা অঞ্চলে বসবাস রত অনিচুর রহমান বলেন, ”আমাদের এখানে প্রতি বছর গরমের সময় দিন দিন গরম যেন বাড়ছেই। আবার ভারী বৃষ্টিপাত হলে আমাদের বাসার নিচে পানি জমে যায় আমাদের দোকান তলিয়ে যায় যা আগে কখনই দেখিনি। “সরকারের কাছে সংকট থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা জানিয়ে আনিচুর বলেন, “নিরাপদ খাদ্য এবং পানির সুব্যবস্থা করা খুব জরুরি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝায় গর্ভবতী মা এবং বৃদ্ধ লোকেরা, প্রতিবন্ধীরা নানা ঝুঁকির মুখে পড়ছে। তাদের সেই সময়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকলের সাহায্য দরকার আমাদের।”

Check Also

দুর্নীতিবাজ, খুনি, স্বার্থান্বেষী মহলকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাই না: চরমোনাই পীর

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, ইসলামী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।