আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ সংস্কার,অযতœ,অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসের পথে দেড় শতাধিক বছরের পুরনো পুরাকীর্তির প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন নকিপুর জমিদার বাড়ি । জমিদার হরিচরণ রায়চৌধুরীর একচল্লিশ কক্ষের তিনতলা বিশিষ্ট এল প্যার্টানের এই বাড়ি নির্মাণ করেন ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথার অবসান ঘটরা মধ্য দিয়ে বিলিন হতে থাকে জমিদার বাড়িটি। যার অবস্থান সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে প্রায় ৭২ কিলোমিটার দূরে শ্যামনগর থানা সদর থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বে শ্যামনগর উপজেলার নকিপুরে। জমিদার বাড়ির দক্ষিণ অংশের ভবন ইতোমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অন্যদিকে দৃষ্টিনন্দন এল প্যার্টানের কোন অস্তিত্বই নেই। এখন চলছে মধ্যভাগের ভাঙন। বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায় হাতেগোনা কয়েকটি পরিত্যক্ত কক্ষেই ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েকটি পরিবার। জমিদার বাড়িটি আজ ধ্বংসের শেষ সীমানায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ করা গেলে এটিও হতে পারে দেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র্র্র।
শ্যামনগর আসনের সাবেক এমপি গাজী নজরুল ইসলাম জানান, জমিদার হরিচরণ রায় চৌধুরী ১৮৮৮ সালে তিন তলা বিশিষ্ট এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। এ বাড়ির পাশেই রয়েছে দুর্গামন্ডপ, নহবতখানা, শিবমন্দির ও জলাশয়সহ বিভিন্ন নির্দেশন। যা দেখে সহজে অনুমান করা যায় এর অতীত জৌলুস। রাজা প্রতাপাদিত্যের পরে হরিচরণ রায় ছিলেন শ্যামনগর অঞ্চলের প্রভাবশালী জমিদার। তিনি সাতক্ষীরা জেলাব্যাপী রাস্তা, খাল খনন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেন। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নকিপুর মাইনর স্কুলটি নির্মাণ করেন (যা বর্তমানে নকিপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত)। তিনি আরো জানান, ১৯৭১ সালে জমিদার বংশের লোকজন ভারতে চলে যান। পরে জমিদার বাড়ির বিভিন্ন দামি জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। একইসঙ্গে বাড়িটি দখলে নেয় কিছু ভূমিদস্যু। তবে পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির পাশের দুর্গামন্ডপ, নহবতখানা, শিবমন্দির, জলাশয় ইত্যাদি দেখে সহজে অনুমান করা যায় এর অতীত সৌন্দর্য। দক্ষিণবঙ্গের প্রতাপশালী শাসক রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের ধুমঘাট এলাকায়। তার বংশের রাজত্ব প্রায় ২৫০ বছর ছিল। পরে জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরী শ্যামনগরের নকিপুরে একছত্র অধিপতি ছিলেন। শ্যামনগরে সদ্য জাতীয়করণকৃত নকিপুর এইচ.সি (হরিচরণ চৌধুরী) পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অরক্ষিত পুরাকীর্তির নিদর্শন এই জমিদার বাড়িটি অতি দ্রুত সংরক্ষণের দাবি জানান।
অবসরপ্রপ্ত প্রধান শিক্ষক চারুচন্দ্র মন্ডলের লেখা একটি বই থেকে জানা যায়, জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরীর বাড়িটি ছিল সাড়ে তিন বিঘা জমির উপরে। যার বাউন্ডারিটি ছিল প্রায় দেড় হাত চওড়া প্রাচীর দ্বারা সীমাবদ্ধ। সদর পথে ছিল একটি বড় গেট বা সিংহদ্বার। সম্মুখে ছিল একটি শান বাঁধানো বড় পুকুর। দেড় শতাধিককাল পূর্বে খননকৃত এই পুকুরটিতে সারাবছরই পানি থাকে এবং গ্রীষ্মের দিনে প্রচন্ড তাপদাহে তা শুকায় না। পুকুরঘাটের বাম পাশে ৩৬ ইঞ্চি সিঁড়ি বিশিষ্ট দ্বিতল নহবত খানা। আটটি স্তম্ব¢ বিশিষ্ট এই নহবত খানার ধ্বংসাবশেষটি এখনো প্রায় অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে কালের সাক্ষী বহন করছে। বাগান বাড়িসহ মোট বার বিঘা জমির উপর জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাড়িটি ছিল সত্তর গজ লম্বা, তিন তলা বিশিষ্ট ভবন। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই সম্মুখে সিঁড়ির ঘর। নিচের তলায় অফিস ও নানা দেবদেবীর পূজার ঘর ছিল। এছাড়া নিচের তলায় ১৭টি এবং উপরের তলায় ৫টি কক্ষ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ছোট, বড়, মাঝারি সব রকমের কক্ষ ছিল। বিল্ডিংটির দৈর্ঘ্য ২১০ ফুট, প্রস্থ’ ৩৭ ফুট, ৬৪ ফুটের মাথায় এল প্যার্টানের বাড়ি। প্রথমবার ঢুকলে কোন দিকে বহির্গমন পথ তা বোঝা বেশ কষ্টদায়ক ছিল। চন্দন কাঠের খাট-পালঙ্ক, শাল, সেগুন, লৌহ কাষ্ঠের দরজা-জানালা, লোহার কড়ি, ১০ ইঞ্চি পুরু চুন-সুরকির ছাদ, ভেতরে কক্ষে কক্ষে গদি তোষক, কার্পেট বিছানো মেঝে, এক কথায় জমিদারী পরিবেশ। বাড়িতে ঢুকতে ৪টি গেট ছিল। গেট ৪টি ছিল ২০ ফুট অন্তর। জমিদার বাড়ির দক্ষিণে একটি বড় পুকুর ছিল। জমিদার পরিবার এখান থেকে স্ব-পরিবারে ভারতে চলে যাওয়ার পর বর্তমান সে পুকুরটি আর নেই। নেই পূর্বের মতো সৌন্দর্য। তবে তার দক্ষিণে এখনো একটি পুকুর বিদ্যমান, যার শান বাঁধানো ঘাটের ধ্বংসাবশেষটির দুই পাশে দুটি শিব মন্দির। দক্ষিণবঙ্গের প্রতাপশালী শাসক রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের ধুমঘাট এলাকায়। তাঁর রাজত্বের প্রায় ২৫০ বছর পরে জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরী শ্যামনগরের নকিপুরে একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন। শ্যামনগরে সদ্য জাতীয়করণকৃত নকিপুর এইচ.সি (হরিচরণ চৌধুরী) পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি তিনিই প্রতিষ্ঠি করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর বসতবাড়িটি যা দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থাপত্য হিসেবে পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারতো তা আজ সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
শ্যামনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জানান, এর মধ্যে জমিদার বাড়িটির অবৈধ দখলমুক্ত বা উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে আদালতে মামলা থাকায় একজনকে উচ্ছেদ করা যায়নি। এর আগে সাবেক বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদ স্ব-স্ব উপজেলার ঐতিহাসিক এবং দর্শনীয় স্থান সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভূমি কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশ অনুযায়ী নকিপুর জমিদার বাড়িটি অবৈধ্য দখল মুক্ত করে পর্যটন কেন্দ্র্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করা চলছে। তবে ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি পূর্বের নান্দনিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুময়িুন কবির জানান, শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর জমিদার বাড়িটি পুরাকীর্তির অপূর্ব নিদর্শন এবং জেলার দর্শনীয় স্থান। দেড়শ বছর আগের জমিদার বংশের গৌরবময় ঐতিহ্যের নানা নির্দশন রয়েছে এ বাড়িতে। জেলা প্রশাসন জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণে এর মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে।