ইচ্ছা থাকলেও জটিল প্রক্রিয়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে দেশি- বিদেশি পর্যটকরা

আবু সাইদ , সাতক্ষীরাঃ সুন্দরবন ভ্রমণে দিন দিন মানুষের আগ্রহ বাড়লেও পর্যটন নীতিমালা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে সম্ভাবনাময় এ খাতের প্রসার ঘটছে না। চরম অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে ক্রমেই হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবন ভ্রমণ। নিরাপত্তা, অনুমতি, খরচ আর জটিল প্রক্রিয়ার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে সুন্দরবন ভ্রমণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বনের আকর্ষণীয় আটটি স্থানের অধিকাংশ স্থানেই নেই যাত্রীদের লঞ্চ থেকে নামার কোনও সু ব্যবস্থা। মাঝ নদীতে লঞ্চ থামিয়ে দর্শনার্থীদের ট্রলারে করে তীরে যেতে হয়। ফলে সুন্দরবন ভ্রমণে যাওয়া দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত যথেষ্ট উপাদান থাকা সত্বেও কেবল প্রচার-প্রচারনা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে সুন্দরবন ঘিরে পর্যটনের বিকাশ হচ্ছে না। সুন্দরবনের নির্ধারিত স্থানগুলোতে কোন বয়াবাতি না থাকায় লঞ্চ বা জাহাজ চালাতে সমস্যা হয়। কটকার মুখে বয়া থাকলেও বাতির ব্যবস্থা নেই। ২০১০ এর ২৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নকীপুর হাইস্কুল মাঠে এক বিশাল জনসভায় সুন্দরবনের মুন্সিগঞ্জ থেকে যশোরের নাভারন পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর থেকে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ৬টি স্টেশন সমৃদ্ধ এবং ২টি রেলসেতু সমৃদ্ধ রেললাইন স্থাপনে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১৬৬২ কোটি টাকা। এরপর থেকে বিষয়টি ফাইলবন্দী হয়ে আছে। রেললাইন স্থাপনে কোন অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না।
বন বিভাগের সূত্রমতে প্রতিবছর জুলাই থেকে সুন্দরবনে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়। তবে সুন্দরবন ভ্রমণের উপযুক্ত সময় হচ্ছে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। প্রতি বছর এ সময় দেশি-বিদেশি পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণে আসেন। সুন্দরবনের ভেতরে বর্তমানে আটটি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোতে বছরে প্রায় দুই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। বন বিভাগ বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগ থেকে রাজস্ব আহরণ করা হয়েছে ৪ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকায়। সুন্দরবন ভ্রমণের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেলে রাজস্ব আয় বাড়বে আরো কয়েকগুণ। পর্যটনকেন্দ্র গুলো হলো পূর্ব বন বিভাগের আওতাধীন করমজল, হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী ও দুবলার চর। আর পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন হিরণ পয়েন্ট (নীল কমল), কলাগাছী ও কাগা দোবেকী। এসব স্থানে ভ্রমণ করা পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সাতক্ষীরা দিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ নিঃসন্দেহে বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে আসা জলভেজা শীতল হাওয়া। বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট,ও বরগুনা দিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণে যেয়ে থাকে পর্যাটকরা। তবে সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণ করে থাকে সাতক্ষীরা দিয়ে। সাতক্ষীরা থেকে ভ্রমণের জন্যে উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে রয়েছে কলাগাছিয়া, দোবেকী, নোটাবেকী, পু¯পকাটি, বঙ্গবন্ধুর চর, পুটনির দ্বীপ, বিবিরমেদে, করমজল, হারবাড়িয়া, কছিখালি, কটকা, জামতলা, হিরণ পয়েন্ট ও দুবলার চর।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জে বাস কিংবা পরিবহন থেকে নামলেই দেখা যায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের দৃশ্য। একপাশে সড়ক পথ, অন্যপাশে গভীর সুন্দরবন। মাঝখানে প্রবাহমান নদীর তীরে সুন্দরবনের আদলে তৈরি ইকোটুরিজম আকাশলীনা। সড়ক পথে সুন্দরবনের দৃশ্য উপভোগ কতে চুনা ও মালঞ্চ নদীর কোল ঘেঁষা শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের কলবাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে আকাশলীনা ইকো ট্যুরিজম সেন্টার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ আধার। পর্যাটকরা বলছে, সাতক্সীরা হয়ে সুন্দরবন গেলে প্রথমে দেখা মিলবে অপরূপ সৌন্দর্যের লিলাভূমি কলাগাছিয়া। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনি স্টেশনের অধীনে এই ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রর অবস্থান। এর পরবর্তী দোবেকি। সাতক্ষীরা থেকে কাছে করমজল । এটি মূলত বন বিভাগের হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র। হারবাড়িয়া সুন্দরবনের অন্যতম একটি পর্যটন স্থান। শ্যামনগর থেকে দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। এখানের মূল আকর্ষণ বনের ভিতর দিয়ে যাওয়ার কাঠের ট্রেইল। পুরো ট্রেইলটা ঘুরে আসতে ৩০ মিনিটের মত সময় লাগে। এখানে একটি পুকুর ও ওয়াচ টাওয়ার আছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে থেকে পুরো হাড়বাড়িয়া দেখা যায়। বনের ভিতরের কাঠেরপুল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যে কারোরই অ্যাডভেঞ্চার ও শিহরণ জেগে উঠবে। কটকা ফরেষ্ট ষ্টেশনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। আর সাগর কোল ঘেষেই কটকা আভায়ারন্যটি। কটকায় সবচেয়ে চমৎকার যে বিষয়টি তা হলো এখানে দেখা মিলবে বন্য হরিণ দলের সাথে। এখানেও আছে বনের ভিতর একটি কাঠের ট্রেইল । কেওড়া বনের মাঝ দিয়ে ট্রেইল ধরে মিনিট ১৫ হাটলেই দেখা যাবে হরিণের দল। কটকা পয়েন্ট এর ট্রেইল ধরে আরও কিছুদূর হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে কটকা সমুদ্র সৈকতে। বঙ্গোপসাগরের দেখা মিলবে এইখানে। কটকা সী বিচ অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। এখানে বেলাভূমি জুড়ে আঁকা থাকে লাল কাঁকড়াদের শিল্পকর্ম।কটকার কাছেই জামতলা । এখানে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার রয়েছে, এই টাওয়ার থেকে সুন্দরবনের সৌন্দর্যের কিছুটা অংশে একসাথে চোখ বুলানো যায়। জামতলা ঘাট থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথে গেলে দেখা যাবে জামতলা সী বীচের।মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতের কিছুটা অংশ এখনো অনাবিস্বৃত বলে মনে করা হয়। এখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। সুন্দরবন এলাকার মধ্যে ছোট্ট একটি চর হচ্ছে দুবলার চর ও হীরন । নদীর দু’পাশে সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য, সবুজে আচ্ছন্ন গাছপালায় উড়ে বেড়াচ্ছে নানা জাতের পাখি। ভাগ্য ভালো হলে চোখে পড়তে পারে নদীতে হঠাৎ ভেসে ওঠা কুমির ও শুশুক। ঘন জঙ্গলে ঘেরা নদীর পাড়ে হরিণের পাল ও বাঘ সব মিলে সুন্দরবন ভ্রমণ।
দেশের দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধার আওতায় আনতে যোগাযোগ ব্যবস্থা সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুন্দরবন থেকে যশোরের নাভারন পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন সাতক্ষীরাবাসী। ২৫ লাখ জন অধ্যষিত সাতক্ষীরা জেলার ওপর দিয়ে সুন্দরবনকে সংযুক্ত করে এই প্রকল্প স্থাপনের ব্যাপারে সরকারে উদ্যোগ এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এ কারণে আগামী অর্থবছরে রেললাইন স্থাপনের একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। সম্প্রতি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন বিশিষ্ট জনেরা। জেলা প্রশাসক মোঃ হুমায়ুন কবির সেটি গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রেরনের আশ^াস দিয়েছেন।

Please follow and like us:

Check Also

শ্যামনগরে পানি, স্যালাইন ও তরমুজ বিতরণ জামায়াতের

হুসাইন বিন আফতাব, নিজস্ব প্রতিবেদক:তীব্র তাপদাহ থেকে জনসাধারণকে স্বস্তি দিতে সাধারণ মানুষের মাঝে বোতলজাত পানি, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।