আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তায় নতুন মাত্রা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত। ২৭ দেশের এই জোট জানিয়ে দিয়েছে আসন্ন নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। প্রয়োজনে ছোট একটি বিশেষজ্ঞ দল আসতে পারে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে না ইইউ বুধবার রাতে এই খবর প্রকাশ করে মানবজমিন। যদিও ওই দিন রাতে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট কেউ ইইউ’র সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। গতকাল দুপুরে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি প্রকাশ করেন।
এর আগে ঢাকা সফর করে যাওয়া ইইউ’র প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান (হাই রিপ্রেজেনটেটিভ) জোসেপ বোরেলের নেয়া এই সিদ্ধান্তের কথা চিঠির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করা হবে কিনা, তা এই মুহূর্তে যথেষ্ট স্পষ্ট নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও ইইউ বর্তমানে এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকার ব্যাপারে অন্যান্য বিকল্প খতিয়ে দেখছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠিতে ইইউ’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হয়, তা নিশ্চিত করতে তারা সব ধরনের প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করছে।
চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন সচিব জানিয়েছেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ২০২৩-২৪ সালের জন্য ইইউ’র বরাদ্দ বাজেটের স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জরুরি। এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্ত নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুনিয়ার সকল নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে বেড়াচ্ছে ইইউ। তাদের যদি আর্থিক সংকটই থাকতো তাহলে প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছিল কেন? এর পেছনে অন্য কারণ আছে জানিয়ে তারা বলেন, দেশে নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ না থাকার কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি বড় প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল সার্ভে করে গেল।
বিজ্ঞাপন
তখন তো তারা বাজেটের সমস্যার কথা বলেননি। কাজেই পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। তিনি বলেন, নির্বাচনের চার মাস আগে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে কথা বলছে। মামলা-মোকাদ্দমা ও ধরপাকড় করা হচ্ছে। প্রতিদিনই বড় বড় নেতাদের নামে মামলা হচ্ছে। জেলে পাঠানো হচ্ছে। নির্বাচনের পরিবেশ তো এখনো তৈরি হয়নি। কাজেই এই পরিবেশে হয়তো তারা পূর্ণাঙ্গ দল পাঠাতে চাচ্ছে না। কয়েকটি পত্রিকাতেও নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে ইইউ’র প্রশ্ন রয়েছে বলে নিউজ করা হয়েছে। আমিও এমনটাই মনে করি। নির্বাচন কমিশন চিঠিটা প্রকাশ করলেই সঠিক তথ্যটি জানা যাবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের যদি আর্থিক সমস্যাই থাকবে, তাহলে তারা প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছিল কেন? এর মাধ্যমে মূলত অনাস্থা প্রদর্শন করা হয়েছে। ইইউ মনে করে বর্তমান পরিস্থিতিতে বা পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এজন্য মূলত তারা পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যদি শুধুমাত্র বাজেট সমস্যার কথাই বলা হয়ে থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশন সেই চিঠিটা প্রকাশ করুক। চিঠি প্রকাশ না করে মানুষের চোখে ধুলো দেয়া হচ্ছে। প্রতারণা করা হচ্ছে। চিঠি প্রকাশ করলে জানা যেত ইইউ কেন পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে না। বাংলাদেশের সংবিধানকে যেভাবে অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে তার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না এটি বুঝতে নিউটন হওয়ার দরকার হয় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক দল পাঠালে নির্বাচনের জন্য অবশ্যই ভালো হতো। নির্বাচনে বড় ধরনের কারচুপি হলে তাদের নজরে আসতো। তবে আর্থিক সীমাবদ্ধতা প্রত্যেকের থাকে। আর্থিক সমস্যা থাকলে কিছু করার থাকে না।
ওদিকে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে হেড অব ডেলিগেশন আছেন, তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে একটি মেইল পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, গত ৬ থেকে ২২শে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে তিনি যে সাক্ষাৎ করেছিলেন সেটা অত্যন্ত ফলপ্রসূ ছিল। সেজন্য সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন। মেইলে তিনি উল্লেখ করেছেন, ইতিমধ্যে তাদের সদর দপ্তর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের যে পূর্ণাঙ্গ একটি মিশন নির্বাচন (দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন) পর্যবেক্ষণে পাঠানোর আর্থিক বিষয় ছিল, ডিউ টু বাজেট; এটার কারণে তারা আপাতত নামঞ্জুর করেছেন। আপাতত না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এই মেইলে এসব কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। শুধু তারা সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং শেষে এ কথাও বলেছেন কাজী হাবিবুল আউয়াল সাহেবকে, তার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে। ছোট দল আসবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, উনি যেহেতু পরবর্তীতে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবেন, উনি আবার আসবেন, কথা বলবেন, তখন হয়তো অন্য কোনো আলাপ-আলোচনা হতে পারে। এই সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে কিনা জানতে চাইলে ইসি সচিব বলেন, এটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভালো বলতে পারবেন। এই চিঠির ভাষায় এ রকম কিছুর উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র তারা অবহিত করেছেন সিইসিকে যে, তারা পূর্ণাঙ্গ দল পাঠাবেন না। শোনা যাচ্ছে প্রতিনিধিদল নির্বাচন নিয়ে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমি যতটুকু সিইসি’র কাছ থেকে পেয়েছি, তাতে এই জাতীয় কোনো শব্দের উল্লেখই নেই।