#পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে খাপখাইয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে কম্বাইন্ড হারভেস্টার
রাজনৈতিক বিবেচনায় কৃষি প্রণোদনা না দিয়ে প্রান্তিক চাষিদের মাঝে বিতরণের দাবী
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: আশ্বিনের আকাল কাটতে আউশের জনপ্রিয়তা বাড়ছে উপকূলীয় অঞ্চলে। গত কয়েক বছর ধরে জেলায় আউশ চাষে মাইল ফলক রেখে চলেছে এখানকার চাষিরা। খাদ্য সংকট কাটাতে কৃষকের ঘামঝরা পরিশ্রম আউশ চাষে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে। জেলার বেশির ভাগ এলাকায় আউশ ধান ঘরে তুলতে ব্যস্থ সময় পার করছে চষিরা। কাটতে শুরু করেছে আশ্বিনের আকাল। ধান সংগ্রহে কৃষকরা কম্বাইন্ড হারভেস্টার ব্যবহার করছে। এটি কৃষকদের মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছে। কম খরচে এবং জলাবদ্ধ ক্ষেত থেকে ধান ওঠানোর এটি একটি সহজ প্রক্রিয়া। প্রণোদনার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে আউশের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ। যদিও বেঁড়ি বাঁধ ভাঙ্গন, জলাবদ্ধতা,কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ নানা সমসায় জর্জরিত এখানকার কৃষকরা।
কৃষিবিভাগ জানায়, চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে আউশের আবাদ হয়েছে সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে। যা বিগত ১০ বছরের মধ্যে দ্বিগুণ। দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলাতেই ২.৫৫ লাখ হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ হয়েছে। যেখান থেকে ধান উৎপাদন হবে সাড়ে ৬ লাখ টন। অন্যদিকে দেশে ১৩ লাখ ৯৫ হাজার ৩৪১ হেক্টরে আউশ আবাদের মাধ্যমে ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টনেরও বেশী চাল উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি মন্ত্রনালয়। কৃষিবিভাগ আরও জানায়, সরকার আউশ ধানের উৎপাদন বাড়াতে দেশের কৃষকদের ৫৭ কোটি টাকা প্রনোদনা দিয়েছে। বোরোর ওপর চাপ কমানোর পাশাপাশি সেচের সুব্যবস্থা কম এমন এলাকায় আউশ ধানের বিভিন্ন জাত জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে গত কয়েক বছর ভর্তুকি ও প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু ওসব পদক্ষেপের পরও আউশের আবাদ ও উৎপাদন আশানুরূপ বাড়ছে না। এর পরও বোরো ও আমনের মধ্যবর্তি সময়ে আউশের আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ টন দানাদার খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তাকে আরো সংহত করা সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষিবীদ গন। তবে সে লক্ষে ব্রি উদ্ধাবিত সব উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানবীজ ও এর আবাদ প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে পৌছাতে ডিএই’র যথাযথ ভ’মিকা পালনের তাগিদ দিয়েছেন কৃষিবীদগন।
কৃষি খামারবাড়ির সূত্রমতে, তিন বছর আগে দেশে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে আউশ ধান আবাদ হতো। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা এক লাফে দুই লাখ হেক্টর বেড়ে যায়। গত ২০২১-২২ মৌসুমে আউশ ধানের আবাদ হয়েছে ১৩ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদের আওতায় জমির পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে দ্রæত সম্প্রসারণের ফলে আউশ ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। গত তিন মৌসুম আউশের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে সরকারের কৃষিবান্ধব নানামুখী উদ্যোগ, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে আউশ ধানের বীজ ও সার বিতরণ। এ ছাড়া স্বল্প জীবনকালের উচ্চফলনশীল জাতের আউশ ধানের জাত উদ্ভাবন, কৃষক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রম এবং কৃষকদের মধ্যে আউশ ধান আবাদের সুফল ও উপকারিতা যথাযথভাবে তুলে ধরার ফলে আউশের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে গত ১০ বছরে আউশ আবাদ বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১০-১১ সালে জেলায় আউশ আবাদ হয়েছিল ৪ হাজার হেক্টর জমিতে, চলতি বছর ২০২২-২৩ সালে আবাদ হয়েছে সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০২১-২২ মৌসুমে ৮ হাজার ২৮৫ হেক্টর জমিতে আউশ ধান চাষ করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৬ হাজার ২২৭ হেক্টর জমিতে আউশ ধান চাষ করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে জেলায় মোট আউশ ধান চাষ করা হয়েছিলো ৫ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পারকুখরালী গ্রামের আদর্শ কৃষক মো. মতিয়ার রহমান চলতি মৌসুমে ১৫ বিঘা জমিতে হাইব্রিড শক্তি-২ ও জামাইবাবু জাতের আউশ ধান চাষ করেছেন। যা গত মৌসুমের তুলনায় ৫ বিঘা বেশি পরিমান। তিনি জানান, এবার প্রতি বিঘাতে উৎপাদন খরচ পড়ছে ৭ থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। কৃষক মতিয়ার আরো বলেন, ক্ষেতে যে পরিমান ফলন এসেছে তাতে করে ১৫ বিঘাতে এবার ২৫০ থেকে ২৬০ মন ধান উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন তিনি। কৃষক মতিয়ার রহমান অভিযোগ করে বলেন, সরকার আউশ উৎপাদনে প্রনোদোনা দিয়ে থাকে। কিন্ত আমি এই গ্রামের একজন আদর্শ কৃষক হয়েও কখনো বিনা মুল্যে বীজ, সার বা সেচ সহায়তা পাইনি।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, কয়েক বছরে জেলাতে আউশের আবাদ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। কারণ আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার আপলিফট করা লাগছে না। সুতরাং বোরোর তুলনায় আউশের উৎপাদন খরচ অনেক কম। তবে কৃষকরা বলছেন মজুদদারি সিন্ডিকেট ভেঙে সরকার নিজস্ব প্রভাব বলয় গড়ে তুলতে না পারলে এই সাফল্য কৃষকের উপকারে আসবে না। আউশের সংযুক্তিতে ধানের দুই ফসলি জমিগুলো তিন ফসলিতে উন্নীত হওয়ায় বদলে যাচ্ছে এ অঞ্চলের ফসল-বিন্যাস।
সাতক্ষীরা খামারবাড়ি উপপরিচালক কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম জানান,অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় আউশ ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তাছাড়া কৃষকরা আউশ ধানে উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছে। বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের বিনা মুল্যে বীজ, সার ও সেচ সহায়তা প্রদান করায় জেলায় আউশ ধান চাষ বাড়ছে। তিনি আরো বলেন, উপকুলীয় হওয়ার পরও কৃষি সমৃদ্ধ সাতক্ষীরা জেলা। এখানে ধান উৎপাদন খুবই ভালো হচ্ছে। তাছাড়া লবণাক্ত এলাকাতেও ধান চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে অনেক লবন পানির মৎস্য ঘেরে এখন বিভিন্ন প্রকার লবন সহিঞ্চু জাতের ধান উৎপাদন হচ্ছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি বলেছেন, আউশ ধানের আবাদ বাড়াতে যা যা করণীয় তা করে যাচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে খাপখাইয়ে ক্লাইমেট স্মার্ট এবং স্বল্প জীবনকালের অথচ উচ্চফলনশীল আউশ ধানের জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)সহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যা ভবিষ্যতে ভূগর্ভস্থ পানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষাসহ স্বল্পখরচে বৃষ্টিনির্ভর আউশের আওতায় জমির পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে আউশ তথা সার্বিকভাবে ধানের মোট উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।