আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে প্রতি বছর উপকূলীয় অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি, সুপেয় পানির অভাব, কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়াসহ নানা কারণে দেশের ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। যার বেশিরভাগ মানুষই উপকূলে বসবাস। আর এসব সংকটের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে নারীরা। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ক্রমেই প্রকট হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। চরম তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা ও খরা, অধিকতর তীব্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঋতু পরিবর্তন, নদীভাঙন, সাগরে লবণাক্ততা বৃদ্ধি বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০৫০ সালে দেশের প্রতি ৭ জনে একজন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছে বিশেজ্ঞরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা। উদ্বাস্তুতের সেই প্রক্রিয়া ইত্যোমধ্যে উপকূলীয় জেলা সমূহে শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে জলবায়ু অভিবাসীদের সংখ্যা ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে সেই ধারা অব্যাহত থাকলে রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচটি বড় শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। যে কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ সমূহের কার্যকরী বাস্তবায়ন দেখতে চান পরিবেশ বিশেজ্ঞরা।
বিশ্ব আবহায়া সংস্থা (ডবিøউএমও) এর মতে গত ৫০ বছরে শুধু দুর্যোগে বাংলাদেশেই প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দ্য ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে বিশ্বে আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগ ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত বিশ্বে ৭৯৭টি চরম দুর্যোগপূর্ণ ঘটনা ঘটে। আড়াই বছরে বিশ্বস্বাস্থ্য খাতে ১২৯ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৮০ সালের পর বিশে^ চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বেড়েছে। গত ২০ বছরে গড়ে প্রতিবছর ৯০০টির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৮০ দশকে বছরে যেখানে বৈশি^ক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২০০ কোটি ডলার, এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি ডলারে। গত ৩০ বছরে প্রতিবছর গড়ে বৈশ্বিক জিডিপির ২ শতাংশ হারাতে হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। আগামী দশকে তা ৯ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘কি হাইলাইটস: কান্ট্রি ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যানুসারে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি ডলার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ভয়াবহ বন্যার সময় বাংলাদেশের জিডিপি ৯ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি রোধে পর্যাপ্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে, যতই দিন যাবে, বাংলাদেশ আরো ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হবে। ফলে একদিকে যেমন মোট ভূখন্ডের উল্লেখযোগ্য অংশ তলিয়ে যাবে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার জীবনমানে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের প্রভাব শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষের জীবনযাত্রার মানে অবনতি ঘটবে। জলবায়ুর এই ঝুঁঁকিতে নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।এ বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডক্টর আমিনুল ইসলাম বলেন, উপক‚লীয় ঝড়ের কারণে নদীতীরবর্তী মানুষের একটা বড় অংশের উদ্বাস্তু হবে।
বাংলাদেশের মোট ভূখন্ডের তিন ভাগের দুই ভাগই সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৫ ফুটের কম উচ্চতায় অবস্থিত। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বাড়ছে। এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রতি সাতজনের একজন বাস্তুচ্যুত হবে। কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণেই ২০৫০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। সময় যত গড়াবে, পরিস্থিতি তত ভয়াবহ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’-এর বরাতে ‘দি ক্লাইমেট রিয়ালিটি প্রজেক্ট’-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কয়েকজন বিজ্ঞানী পূর্বাভাস দিয়েছেন যে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা পাঁচ-ছয় ফুট বাড়বে। এর ফলে পাঁচ কোটি মানুষ গৃহহীন হবে।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মুহা হুমায়ুন কবির বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএপি) ২০০৯, বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান ২০৩০ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে নেয়া এসব পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তবায়ন চান সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনগুলোয় নিজের অবস্থান আরো বেশি শক্তিশালী করা, যেসব উন্নত দেশ অত্যধিক হারে কার্বন নিঃসরণ করে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে, তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক বৈঠকের আয়োজন করাসহ তাদের কর্মকান্ডের ফলে এ দেশ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তার বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরার পরামর্শ জলবায়ু বিশেজ্ঞদের।
আবু সাইদ বিশ্বাস
সাতক্ষীরা
১৬/১০/২৩