বাংলাদেশের শ্রম ও মানবাধিকার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় কমিশন। অর্থনীতিবিদরা এই প্রতিবেদনকে ‘সতর্ক বার্তা’ হিসেবে উল্লেখ করে বলছেন, ইউরোপীয় কমিশনের উদ্বেগের বিষয়গুলো বাংলাদেশের গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।
ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ বর্তমানে ইবিএ (এভরিথিং বাট আর্মস) সুবিধা পায়। এর অর্থ হচ্ছে, অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়া রপ্তানিযোগ্য সব পণ্যের ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটা-মুক্ত প্রবেশাধিকার।
এই সুবিধার আওতায় বর্তমানে ৪৭টি দেশ রয়েছে। এই দেশগুলোকে ইউরোপে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নির্ধারিত ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটার মানে এটা নয় যে তারা ইবিএ থেকে উইথ-ড্র করবে সেইটা না, তাদের কিছু কনসার্ন আছে। সুতরাং সেদিক থেকে অবশ্যই এটা আমাদের সিরিয়াসলি নেয়া উচিত।”
গত ২১শে নভেম্বর ইউরোপীয় কমিশন জিএসপি নিয়ে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনের সাথে হাই রিপ্রেজেনটেটিভ অব দ্য ইউনিয়ন ফর ফরেইন অ্যাফেয়ার্স এন্ড সিকিউরিটি পলিসি’র সাথে যৌথভাবে করা একটি স্টাফ ওয়ার্কিং ডকুমেন্টসও রয়েছে।
জিএসপি প্লাসভুক্ত ৯টি দেশের মধ্যে প্রত্যেকটির জন্য এবং ইবিএভুক্ত শুধু তিনটি দেশের জন্য একটি ডকুমেন্টস তৈরি করা হয়েছে।
ইবিএভুক্ত এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং কম্বোডিয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি এই তিনটি দেশের সাথে তাদের ‘কর্মকাণ্ড বাড়িয়েছে’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এসব দেশের সাথে যেসব ক্ষেত্রে ‘কর্মকাণ্ড বাড়ানো’ হয়েছে তার মধ্যে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে যা জাতিসংঘের মূল নীতি ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিবেদন ও পরামর্শের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
এতে ইবিএভুক্ত দেশগুলোতে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও কাউন্সিল, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, সুশীল সমাজ ও ট্রেড ইউনিয়নের বিভিন্ন পরামর্শ বাস্তবায়নের অবস্থা নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
বর্তমানে থাকা জিএসপি নিয়ম-কানুনের মেয়াদ চলতি বছরের শেষদিকে শেষ হয়ে যাবে। নতুন জিএসপি নিয়ম-কানুন গ্রহণের আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
এই সময়ে বর্তমান নিয়ম-কানুনের মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এই মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়ার শেষ ধাপের কাজ করছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং কাউন্সিল।
জিএসপি, জিসপি প্লাস ও ইবিএ কী?
জিএসপি হচ্ছে বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি সহায়তা দেয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য নীতি।
এর মাধ্যমে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশগুলোকে ইউরোপের বাজারে পণ্য আমদানি-রপ্তানির শুল্ক মওকুফ বা কমানো হয়।
বর্তমানে বিশ্বের ৬৫টি দেশ এই সুবিধা ভোগ করছে। তবে ইউরোপের বাজারে এই সুবিধা পাওয়ার জন্য মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, পরিবেশ ও জলবায়ু এবং সুশাসনের বিষয়ে কিছু শর্ত পালন করতে হয়।
স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি
ইউরোপের বাজারে বিভিন্ন দেশের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের তিনটি ভাগ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি বা সাধারণ জিএসপি।
নিম্ন এবং নিম্নমধ্যবিত্ত দেশগুলোকে সাধারণ জিএসপি সুবিধা দেয়া হয়। এর আওতাভুক্ত দেশগুলোকে ইউরোপের বাজারে রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ পণ্যের শুল্ক পুরোপুরি বা আংশিক প্রত্যাহার করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি সুবিধাভুক্ত দেশের সংখ্যা ১০টি।
জিএসপি প্লাস
টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয় জিএসপি প্লাস এর আওতায়। এর আওতায় নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশগুলোকে শূন্য শতাংশ শুল্কের আওতায় আনা হয়।
তবে এর জন্য জিএসপি প্লাসভুক্ত দেশগুলোকে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সুশাসন সংক্রান্ত ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সই করতে হয় এবং সেগুলোকে বাস্তবায়ন করতে হয়।
জিএসপি প্লাসভুক্ত দেশ হতে হলে এর জন্য আবেদন করতে হয়। বর্তমানে জিএসপি প্লাস সুবিধা ভোগকারী দেশের সংখ্যা ৮।
ইবিএ
একটা দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার তিন বছর পর নিয়মানুযায়ী সেটি সাধারণ জিএসপি সুবিধার আওতায় পড়বে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাধারণভাবেই ২০২৯ সালের পর আর ইবিএ সুবিধা পাবে না। এর পর জিএসপির আওতায় আসবে দেশটি। তবে বাংলাদেশ তখন জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার আবেদন করতে পারবে।
যা আছে প্রতিবেদনে
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপে রপ্তানির ক্ষেত্রে ইবিএভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী দেশ।
গত কয়েক দশকে এই সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি মূলত তৈরি পোশাক শিল্প নির্ভর। ২০২২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে হয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে ২২,৬৭২ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ইউরোপে বাংলাদেশের সব রপ্তানিই ইবিএ সুবিধার আওতায় হয়ে থাকে।
২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত কোভিড মহামারি সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অন্য ইবিএভুক্ত দেশের তুলনায় ইতিবাচক ছিল।
২০১৮ ও ২০২১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে দেশটি এই তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার মানে হচ্ছে এর তিন বছর পর বাংলাদেশ ইবিএভুক্ত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে সাধারণ জিএসপি ভুক্ত দেশ হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়মিত তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো বাংলাদেশকে জানিয়েছে। এ পর্যন্ত দুটি পর্যবেক্ষণ মিশন বাংলাদেশ সফর করেছে। একটি ২০১৯ সালের অক্টোবরে এবং আরেকটি ২০২২ সালের মার্চে। এই সফরের সময় ইইউ এর প্রতিনিধিরা আন্তর্জাতিক শ্রম আইন ও মানবাধিকার বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে।
মানবাধিকার নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগের বিষয়ে সীমিত উন্নতি সাধিত হয়েছে। ২০২১ ও ২০২২ সালে নির্যাতন, বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুমের ক্ষেত্রে পূর্ণ তদন্ত করে দায়ীদের ন্যায়বিচারের আওতায় আনতে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশন গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে।
২০২৩ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাবনার বিষয়ে যৌথ মোশন গ্রহণ করেছে।
ভবিষ্যতের যা করতে হবে সে বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রম অধিকারের উদ্বেগের বিষয়ে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, শ্রম অধিকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে হবে। একই সাথে আইএলও এর রোড ম্যাপ অনুযায়ী অর্জিত অগ্রগতি সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য জানাতে হবে।
মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম ও নির্যাতন অভিযোগের তদন্ত করতে হবে। একই সাথে মানবাধিকার কাউন্সিলের সুপারিশ বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নীত হওয়ার আলোকে জিএসপি বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের পূর্ণ বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
এর ফলে বাংলাদেশ ইবিএ থেকে সাধারণ জিএসপি সুবিধাভুক্ত হবে। তখন বাংলাদেশ যে জিএসপির সব ধরণের নিয়ম বিশেষ করে উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো পূর্ণ করতে সক্ষম তা দেখাতে পারে।
বাংলাদেশ তার জিএসপি সুবিধার শর্ত বাস্তবায়ন করছে কিনা তা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা অব্যাহত রাখবে ইইউ। একই সাথে ২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকায় ইইউ এর একটি উচ্চ পর্যায়ের মিশনের মাধ্যমে চলমান সম্পৃক্ততা আরো বাড়াবে।