মাহফিজুল ইসলাম আককাজ : মহান স্বাধীনতার স্থপতি বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন থেকে দেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় সাতক্ষীরায় বারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য নৌ-কমান্ডো ০০০১বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবির পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া সাতক্ষীরার আপমর জনসাধারণকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের স্বাধীনতার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে সাতক্ষীরায় তারই নেতৃত্বে প্রথমে নিউ ইলেকট্রিক থেকে মাইক বের করে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে সংগঠিত হয়ে পাকিস্থানী পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করার আহবান জানানো হয়। এসময় তার পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়ার নেতৃত্বে তৎকালীন চিলড্রেণ পার্কে সাতক্ষীরার গরীব অসহায় ভিখারীদের নিয়ে রুটি বানানোর কার্যক্রম শুরু করেন। এছাড়াও বিপুল পরিমান ডাব সংগ্রহ করা হয়। রুটি ডাব ও গুড় সাতক্ষীরা থেকে যশোর চাঁচড়ার মোড় পর্যন্ত পৌছানোর ব্যবস্থা করতেন। কারণ সেখানে তৎকালীন পাকিস্থানী সেনাদের সাথে যুদ্ধ চলছিল। দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাতক্ষীরা থেকে ঐ খাবার পাঠানো হতো। তার কারণ ছিল পাক হানাদার বাহিনী যেন সাতক্ষীরা অভিমুখে ঢুকতে না পারে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে রাস্তা কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় যেন পাকিস্থানী বাহিনী সড়ক পথে সাতক্ষীরায় ঢুকতে না পারে। তৎকালীন দেশের ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী ঐ পাকিস্থানী বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিছু দিনের মধ্যে যুদ্ধের গোলা-বারুদ ও রসদ ফুরিয়ে যায়। রসদের অভাবে ২৫ দিন যুদ্ধ করার পর পিছু হটে আসে আমাদের দেশের যুক্তিযোদ্ধারা। দেশে যখন পাকিস্থানী বাহিনী আমাদের বাঙালীদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে তখন তার পিতার নির্দেশে মীর মোস্তাক আহমেদ রবি বন্ধুদের নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ভোমরায় প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্প স্থাপন করার পর মুসলীমলীগ নেতা গফুর সাহেবের বাড়ি থেকে সাতক্ষীরার তৎকালীন পাকিস্থানী এসডিও খালেদ খানকে আটক করে ভোমরা ক্যাম্পে নিয়ে যায় সে এবং তার বন্ধুরা। এসময় পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়ার নেতৃত্বে এসডিও খালেদ খানের অস্ত্রাগার দখল করে। সেখানে রক্ষিত সকল অস্ত্র গোলা বারুদ লুট করে দেশের তৎকালীন ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদদের মাঝে বন্ঠন করে দেওয়া হয় যুদ্ধের জন্য।
এদিকে বন্দী খালেদ খানকে প্রাণে না মেরে ভারতীয় বিএসএফ’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। এসময় খালেদ খানকে ভারতের আলিপুর সেন্ট্রাল জেল খানায় রাখা হয়। দীর্ঘ তিন মাস পরে তাকে পাকিস্থানে পাঠিয়ে দেয় ভারত সরকার। এদিকে খালেদ আমাদের হাতে বন্দী হয়ে নিহত হয়েছে শুনে তার ভাই পাকিস্থানী মেজর হারুন খান আমার পরিবারকে মেরে ফেলার জন্য সাতক্ষীরা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ১১৭ গাড়ি হাক হানাদার বাহিনী নিয়ে সাতক্ষীরায় প্রবেশ করে। খান সেনারা প্রথমে বর্তমান অগ্রণী ব্যাংক সেখানে মীর মোস্তাক আহমেদ রবির বাড়ি ছিল। সেই বাড়িটি হারুন খান ডেনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। পরে সে পাক বাহিনী নিয়ে আমার দাদা বাড়ি শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের পাশে সেই বাড়িতে ডেনামাইট চার্জ করে। ডেনামাইট অকার্যকর হলে খান সেনারা বলে ‘এ কোন আউলিয়াকা ঘর, ডেনামাইট বি নেহি ফাটতা’ বলে সেখান থেকে বেড়িয়ে আমাদের সুলতানপুরের বাড়ি অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়।
সাতক্ষীরায় ব্যাংক লুটের সময় তার পিতা ইসু মিয়ার নেতৃত্বে সে ও তার বন্ধুরা লুটেরাদের বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে। লুটেরা বাহিনীর হাতে ভারী অস্ত্র সস্ত্র থাকায় প্রাণ সায়ের খালে অবস্থান নেয় তারা। পাক সেনারা যখন সমর অস্ত্রে সস্ত্রে সাতক্ষীরায় প্রবেশ করে তখন সে ও তার বন্ধুরা ভোমরা ক্যাম্প ছেড়ে ভারতের টাকি জমিদার বাড়ি চলে যায় এবং সেখানে মেজর জলিলের নেতৃত্বে সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। এর পর টাকি থেকে টকিপুরে এক স্কুলে ছাত্র-জনতা নিয়ে ইয়ুথ ক্যাম্প স্থাপন করে। একটি করে ব্যাচ তৈরী করে যুদ্ধের জন্য ১৫ দিনের ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করে। পরবর্তীতে সে তার বন্ধুদের নিয়ে যুদ্ধের জন্য নেভাল কমান্ডোতে যোগ দেয় এবং ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশীর ভাগরতী নদীর তীরে নেভাল কমান্ডোদের ক্যাম্পে অংশ নেয়। সেখান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় নৌ পথে যুদ্ধ করে। দীর্ঘদিন পরিবারের সাথে যোগাযোগ না থাকায় তার মেঝ ভাই মীর মাহমুদ হাসান লাকি তাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে বাহির হয়ে দেশ মাতৃকার টানে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে টাকি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে যোগ দিয়ে সেখান থেকে বিহারের চকোলিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এদিকে দুই ভাইয়ের খোঁজ না পাওয়ায় তাদের পরিবার আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা ভাবতে থাকে দুই ভাই মনে হয় আর বেঁচে নেই। বেশ কয়েক মাস পর সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের দুদলে’তে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে যুদ্ধে অংশ নেয় তার ভাই মীর মাহমুদ হাসান লাকি। মাত্র ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে লাকি মুক্তিযোদ্ধা শেখ অহেদুজ্জামানের নেতৃত্বে পাক বাহিনীর প্রায় এক হাজার সৈন্যের সাথে মোকাবেলা করে বুকে গুরুতর আঘাত পায় লাকি। সেই যুদ্ধে তার বুকের হাড় ভেঙ্গে যায়। এর কিছুদিন পরে ভারতের তারাগুনিয়া গ্রামে একটি নতুন ক্যাম্প উদ্বোধন করেন খুলনার বারী এমপি। সেখানে তার নেতৃত্বে সাড়ে ১২শ’ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। সেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় মীর মাহমুদ হাসান লাকি। আর ঐ ক্যাম্পের মোটিভেটর ছিলেন আমার পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া। এর পর ০৭ ডিসেম্বর শেখ আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে ৪ ট্রাংক মুক্তিযোদ্ধাসহ সে ও তার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মাহমুদ হাসান লাকি এবং তাদের পরিবার সাতক্ষীরায় প্রবেশ করে। সাতক্ষীরা শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে ঐ সময় মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়। তখন দেশ আর পরাধীন নেই। স্বাধীন হয়েছে দেশ, বিশে^র বুকে নতুন মানচিত্র বাংলাদেশ। তার পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মোটিভেটর হিসেবে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্থানি শাসকদের কাছ থেকে তথা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য, জাতির অধিকার আদায়ের জন্য, সর্বোপরি একটি পতাকার জন্য এদেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল আর ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। পাকিস্থানিদের হাতে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে, আর নির্যাতনের শিকার ও সম্ব্রম হারিয়েছেন প্রায় দুই লাখ নারী। পাকিস্থানীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরার জনগণকে সংগঠিত করা ও সকল শ্রেণির মানুষদের উদ্বুদ্ধ করা, খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকার্য এবং আশ্রয়দান ইত্যাদি সব কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে তার পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া ও তাদের পরিবারের ভূমিকা আজো স্মরণ করে সাতক্ষীরাবাসী। তিনি স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরিবার মুক্তিযুদ্ধের এই অনন্য ভূমিকা এবং অবদান ইতিহাসের গৌরবময় সত্য, যা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প মোটিভেটর তার পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়ার পরিবার দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা ও গৌরবোজ্জ্বল অবদান রয়েছে। পাকিস্থানী বাহিনী এই পরিবারের উপর ব্যাপক নির্যাতন, বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ ও ডিনামাইট চাজসর্হ ধ্বংশযজ্ঞ চালিয়েছে। যুদ্ধের সেই ভয়াবহ ঘটনা মনে পড়লে আজো আতকে উঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারসহ সাতক্ষীরাবাসী।
Check Also
সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান
নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। …