‘কঠোর বার্তা’ নিয়ে মাঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

রোববার ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে ‘কঠোর বার্তা’ নিয়ে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচনে নাশকতা ও সহিংসতা হতে পারে-এমন আগাম গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

নির্বাচনের দিন একটি পক্ষ থেকে নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে বলে দাবি করেছেন পুলিশ প্রধান। আর বিজিবি ও আনসার মহাপরিচালক জানান, সব ঝুঁকি মাথায় রেখেই নিরাপত্তা পরিকল্পনা করা হয়েছে।

জানা গেছে, এবারের ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় থাকছে পুলিশ ও র‌্যাবের ১ লাখ ৮২ হাজার সদস্য। বিজিবির ৪৬ হাজার ৮৭৬ সদস্য, কোস্ট গার্ডের ২ হাজার ৩৫৫, আনসার ও ভিডিপির ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৪৩ সদস্য, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-এপিবিএনের ৬ হাজার সদস্য।

এছাড়া ভোটের দিন যে কোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে ফায়ার ফাইটারদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি গঠন করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় কো-অর্ডিনেটর ও মনিটরিং সেল। তাছাড়া নাশকতাকারীদের তথ্য চেয়ে পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।

এদিকে শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে আয়োজিত জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষ্যে নিরাপত্তা ব্রিফিংয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে নাশকতাকারীদের পরিকল্পনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেনে গেছে। নাশকতাকারীরা নির্বাচনের দিন বিকট শব্দে আওয়াজ কিংবা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মানুষের মাঝে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির পরিকল্পনা করেছিল। তাদের সেই পরিকল্পনার তথ্য আমরা পেয়েছি এবং সে অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতিও নিয়েছি। আশা করি এ ধরনের ভীতি সঞ্চার তারা করতে পারবে না।

তিনি বলেন, পুলিশের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। কেউ নাশকতা করতে পারবে না। দু-একটা জায়গায় চোরাগোপ্তা কিছু করতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। এর আগেও সারা দেশে নাশকতার চেষ্টা হয়েছিল, তবে নাশকতাকারীরা কোথাও সফল হতে পারেনি। আমরা সবাই মিলে ৭ জানুয়ারি একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হব।

আইজিপি জানান, শুক্রবার থেকেই প্রতিটি কেন্দ্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট সাইবার ওয়ার্ল্ডে কাজ করছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুজব প্রতিরোধসহ সব কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আইজিপি বলেন, সব কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট একসঙ্গে কাজ করছি। স্থানীয় প্রশাসন ও রিটার্নিং অফিসাররাও একযোগে এক প্ল্যাটফরমে কাজ করছেন। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বা নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে ফলাফল ভালো হবে না। যারা এসব করতে চাইবে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।

একইদিন সকালে রাজধানীতে স্থাপিত বিভিন্ন নির্বাচনি বেজ ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে মিরপুর সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্সে এক ব্রিফিংয়ে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান জানান, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে যে কোনো ধরনের নাশকতা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত রয়েছে বিজিবি। সেই সঙ্গে কাজ করছেন বিজিবির গোয়েন্দা সদস্যরাও। বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, নির্বাচন উপলক্ষ্যে সারা দেশে ১ হাজার ১৫৫ প্লাটুন ও ৪৮৭টি নির্বাচনি বেজ ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি দিন-রাত প্রায় ৭০০ প্যাট্রোল টিম টহলে রয়েছে। সঙ্গে ডগ স্কোয়াডও দায়িত্ব পালন করছে।

বিজিবি প্রধান বলেন, বিশেষ ব্যবস্থাপনায় র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম (র‌্যাট) রয়েছে, যারা দ্রুতগতিতে অলিগলিতে গিয়ে নাশকতা প্রতিরোধে সক্ষম। এছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকলে, দায়িত্ব পালন করবে কুইক রিঅ্যাকশন টিম। তারা হেলিকপ্টারে ঘটনাস্থলে যাবে। এছাড়াও নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বছরই প্রথম চট্টগ্রামের স›দ্বীপে ২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিজিবি সম্পূর্ণ প্রস্তুত জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করবে বিজিবি। নির্বাচন যাতে নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়, সে বিষয়ে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও নাশকতা মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে বিজিবি। পাশাপাশি নির্বাচনের জন্য মাঠে বিজিবি গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করবে।

এদিন দুপুরে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক বলেন, ভোটের নিরাপত্তায় সারা দেশে আনসার-ভিডিপির ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৪৩ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, সারা দেশে ৪২ হাজার ১৪৯টি ভোট কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তা রক্ষায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৭৮৮ জন সাধারণ আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৫০ প্লাটুন আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্যরা এক হাজারটি সেকশনে ভাগ হয়ে ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩ দিনের জন্য স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে মোতায়েন রয়েছে। উপক‚লের ১৩টি উপজেলা বাদে সব উপজেলায় আনসার ব্যাটালিয়নের একটি করে স্ট্রাইকিং টিম নির্বাচনি পরিবেশ অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাখতে সংশি¬ষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার পরিকল্পনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়াও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২ হাজার ৮৫৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন।

মহাপরিচালক বলেন, নির্বাচনি কেন্দ্রের নিরাপত্তায় প্রতিটি কেন্দ্রে ১২ জন করে আনসার ও ভিডিপি সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের মধ্যে একজন প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) ও একজন সহকারী প্লাটুন কমান্ডারের (এপিসি) নেতৃত্বে ছয়জন পুরুষ ও চারজন মহিলা ভিডিপি সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। পিসি ও এপিসিরা অস্ত্রসহ এবং ভিডিপি সদস্যরা লাঠি হাতে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকবেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনোরূপ অবনতি ঘটলে তা দ্রুত সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য তথ্যানুযায়ী ১০ হাজার কেন্দ্রের কথা বলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে আমরা বেশি গুরুত্ব দেব। আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক আছি। যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করব। আমরা সচেতন আছি, নাশকতা নির্মূলে আমরা সক্ষম হব।

এর আগে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে বুধবার থেকে মাঠে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনী (সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী)। তারা ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।

আইএসপিআর জানায়, ৬২টি জেলায় সেনাবাহিনী নিয়োজিত হয়েছে। সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫ উপজেলায় বিজিবি এককভাবে দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া সীমান্তবর্তী ৪৭টি উপজেলায় সেনাবাহিনী বিজিবির সঙ্গে এবং উপক‚লীয় ৪টি উপজেলায় কোস্ট গার্ডের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করবে।
উপক‚লীয় দুটি জেলাসহ (ভোলা ও বরগুনা) ১৯টি উপজেলায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা দেবে। তাছাড়া জরুরি প্রয়োজনে নির্বাচনি সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

নাশকতার তথ্য দিলে মিলবে পুরস্কার : শুক্রবার দুপুরে পুলিশ সদর দপ্তরের এক বার্তায় জানানো হয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা নাশকতা করবে তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পুলিশকে জানালে পুরস্কার দেওয়া হবে। তথ্য দাতা পুরস্কার হিসাবে নগদ ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত পেতে পারেন বলে বার্তায় জানানো হয়। এতে তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে।

এদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে কোনো ধরনের অনিয়ম ও সহিংস কর্মকাণ্ডের অভিযোগ জানানো যাবে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সম্প্রতি জারি করা পরিপত্রে এ বিষয়টি জানানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছে, সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে সার্বক্ষণিক সেবা দিতে জরুরি সেবা ৯৯৯-এ বিশেষ টিম গঠন করে আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সেলের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। ওই টিম ভোটসংক্রান্ত প্রাপ্ত অভিযোগ বা তথ্যের বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরাসরি এলাকাভিত্তিক আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সেলে প্রেরণ করবে।

 

Check Also

তাবলীগ জামায়াতের সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ-সমাবেশ

মুহাম্মদ হাফিজ, সাতক্ষীরা : তাবলীগ জামাতে সাদপন্থীদের বর্বোরিচত হামলার প্রতিবাদ ও সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগের সহসভাপতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।