এইচ এম আকতার
নানা অস্থিরতা আর সংকটের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বিদায়ী বছর। বছরজুড়ে এক ধরনের ছন্দপতনের মধ্যে ছিল দেশের ব্যাংক খাত। সারা বছর জুড়েই ছিল ডলার সংকট। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। নানান নাটকীয়তা আর আইএমএফের শর্তে বেরিয়ে আসে রিজার্ভ গণনায় হিসাবের গরমিল। এসবের মধ্যেই খোলাবাজারে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে ডলারের দর ওঠে ১২৯ টাকায়। আর ব্যাংকিং খাতে9র এসব সংকটে সারা বছরই ছিল দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। যা ভোক্তাকে হাপিয়ে তুলছে।
২০২৩ সালের শুরু থেকেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। বছরের শেষ ভাগে এসে তা আরও বেড়েছে। সরকারের নানা পদক্ষেপেও খাদ্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যায়নি। বেড়েছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। গত আগস্ট মাসে হঠাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো দুই অঙ্কের ঘরে উঠে যায়। যা ছিল গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরের তিন মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশের ওপরে। অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বছরজুড়েই বাজারে জিনিসপত্রের দাম ছিল বেশ চড়া। কখনো ডিম, কখনো আবার পেঁয়াজ বা আলুর দাম বেড়েছে। শাক-সবজি, মাছ-মাংসের দামও ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে। এছাড়া তেল ডাল চিনি আটা ময়দার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দামও ছিল অস্বস্তির পর্যায়ে।
ইলিয়াস যাত্রাবাড়িতে একজন মুদির দোকানদার। তিনি বলেন, জীবনে পণ্যের দামে এতো হেরফের আগে দেখিনি। দোকানে যেমন পণ্য বিক্রি করে শান্তি পাইনি, তেমনই নিজেও ভালোমতো কিনে খেতে পারিনি। এ বছর দামের কারণে বিক্রিও কমেছে। ক্রেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্কেও টান পড়েছে।
ওই এলাকায় বাস করেন, সোহানা নামের একজন গার্মেন্টস কর্মী। চারজনের সংসারে তিনি একমাত্রা উপার্জনক্ষম। তাই সংসার খরচের হিসাবটাও তাকে রাখতে হয় কড়ায়-গন্ডায়। গত বছর তার বেতন বেড়েছে ১৮০০ টাকা, কিন্তু বছরজুড়ে শুধু মাসিক খাদ্য ব্যয় বেড়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। যা তার বর্ধিত বেতনের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
সোহানা বলেন, বাড়তি খরচ সমন্বয় করতে বাচ্চার টিফিনের আইটেম কমাতে হয়েছে। বিকেলের নাস্তার বদলে সন্ধ্যার পরপরই রাতের খাবার খাওয়া অভ্যাস করতে হয়েছে। খাবার আইটেমে মাংস ও বড় মাছ নেই বললেই চলে। এছাড়া আগে নিয়মিত দুধ-ডিম খাওয়া হতো, সেটা এখন বন্ধ। এরপরও নিত্যপণ্যের অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে পারিবারিক বিভিন্ন কেনাকাটায় খরচ কমাতে হয়েছে। এমনকি কোথাও ঘুরতেও যাওয়া হয়নি।
চলতি বছরের দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যা সব শ্রেণির মানুষের জন্যই আতঙ্কের। বাজারে গিয়ে বছরজুড়ে কেউ স্বস্তি পায়নি।
তিনি বলেন, গত এক বছরে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা তেমন একটা কাজে আসেনি। বেশকিছু পণ্য আমদানির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছিল, কিন্তু তার সুফল মেলেনি। এছাড়া বছরের শেষে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতায় নিম্নবিত্তের মানুষের উপার্জন কমেছে। এতে তাদের কষ্ট আরও বেড়েছে।
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সামান্য কমেছে। তবে দাম বেড়েছে এমন পণ্যের তালিকাই দীর্ঘ। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) নিয়মিত বাজার দরের হিসাব রাখে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে শুধু চাল ও আটা-ময়দার দাম কমেছে। অন্যদিকে ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, আলু, ডিমসহ মসলা, মাছ, মাংসের দাম বেড়েছে। বছরজুড়েই বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছুটা দুরবস্থা সৃষ্টি করেছে। বছরের শুরুতে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, ডলারের ঘাটতি, পণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে ডলার সংকট, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিসহ বেশকিছু কারণে দ্রব্যমূল্যের সরবরাহ সংকটও ছিল। তারপরও এ বছর গম, চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো বিভিন্ন আমদানিভিত্তিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। কিন্তু ডলার সংকট এবং জ্বালানির দাম বাড়ায় উচ্চতর আমদানি ব্যয়ের কারণে আমদানিকারকেরা পণ্যের দাম কমায়নি। এতে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে এর সুফল পাননি ভোক্তারা। বরং বছরজুড়ে ওইসব নানা সমস্যাকে পুঁজি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। প্রকৃতপক্ষে যতটুকু দাম বাড়ার কথা তার চেয়ে কয়েকগুণ দাম বাড়িয়ে অবৈধ মুনাফা লুটেছে অতি মুনাফালোভীরা।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর একটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে নয়। এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা। এমন পরিস্থিতিতে সারাবছর প্রশ্ন উঠেছে, ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কে? সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেট কি বেশি শক্তিশালী? এরপর সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে উঠছে না সরকার। এমনকি বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীকেও কয়েক দফা বাজার সিন্ডিকেট প্রতিরোধের তাগিদ দিতে হয়েছে।
এদিকে লাগামছাড়া দাম নিয়ন্ত্রণে চলতি বছর সরকার বেশকিছু পণ্যের দাম বেঁধে দেয়। এরমধ্যে চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, আলু, ডিম অন্যতম। তবে বাজারে কোনো পণ্যই সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়নি। এখনো সেগুলো নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে শুধু ডিমের দাম কমেছে।
যদিও বাজারে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করতে বছরজুড়ে তৎপরতা দেখা গেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। প্রতিদিন সারাদেশে শত শত প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। তবে জরিমানা করলেও পরক্ষণেই একই পণ্য বিক্রি হয়েছে বাড়তি দামে। এর পেছনে সিন্ডিকেট প্রতিরোধে প্রচলিত আইনের দুর্বলতাকে দায়ী করেন বিশ্লেষকেরা।
এসব বিষয়ে কথা হয় ভোক্তা-অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাজারে যা হচ্ছে, সেটাকে ব্যবসা বলা যাবে না। ভোক্তাকে জিম্মি করে ডাকাতি চলছে। এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক।
তিনি আরও বলেন, বাজারে সুশাসনের ঘাটতির কারণেই সমস্যা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছেন, সরকারের কোনো বিধি-বিধানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। যেসব পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেগুলো কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। মাঝেমধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তর কিছু জরিমানা করছে। এতে ব্যবসায়ীদের টনক নড়ছে না। তাদের কিছু যায়-আসেও না। এদিকে ডলার বাজারের এই অস্থিরতার সুযোগ নেয় দেশী-বিদেশী ও রাষ্ট্রায়ত্ত ১০ ব্যাংক। ডলার কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ে এসব ব্যাংক। পাশাপাশি রাজনৈতিক চাপে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণে হয় নতুন রেকর্ড। এসব নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই নতুন করে আলোচনায় আসে বিশেষ বিবেচনায় একটি কোম্পানিকে ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার বিষয়। এত কিছুর মধ্যে কিছু ভালো পদক্ষেপও ছিল ব্যাংক খাতে। স্মার্ট পদ্ধতিতে সুদহার, একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক তিনজনে নামিয়ে আনাসহ কয়েকটি ভালো পদক্ষেপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
সবশেষ আলোচনায় আসে টাকার সংকটে পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম হওয়ার বিষয়। চলতি হিসাবের স্থিতি ঋণাত্মক থাকায় এসব ব্যাংককে ২০ কার্যদিবসের মধ্যে অর্থ সমন্বয়ের সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে পরে চিঠি পাঠানোর বিষয় স্বীকার করেও লেনদেন বন্ধের হুঁশিয়ারির বিষয় অস্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি নিয়ে ওএসডি ভীতি তৈরি হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ে। বছরজুড়েই ছিল অর্থ সংকট। কমতে থাকে রিজার্ভ, উদ্বেগ তৈরি করে রেমিট্যান্স প্রবাহ। এত কিছুর মধ্যেও কিছুটা আশা জাগায় শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়া। সারাবছরই আলোচনায় ছিল আইএমএফের ঋণ। নানান নাটকীয়তার পরে এরই মধ্যে ঋণের দুই কিস্তি দিয়েছে আইএমএফ। বছর শেষে সবার এটাই প্রত্যাশা, ভীতি, রাজনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এবং ডলার সংকট কাটিয়ে স্বাভাবিক লেনদেন ফিরে আসুক ব্যাংক খাতে।
ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিভাগ ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি। এটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারা ছাড়া আর কেউ এ বিভাগের কোনো বিষয় পর্যবেক্ষণ বা তথ্য পেতেন না। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান শাখা এতদিন এ বিষয়ে তথ্য নিতে পারতো। এখন থেকে ব্যাংকগুলোর শাখা অফিসও সিআইবি তথ্য পরিদর্শন ও পরিবর্তন করতে পারবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এতে ব্যাংকারদের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি হবে বলে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট চলছে দীর্ঘদিন। এমনকি ডলারের দর নিয়ে কারসাজি করে ১০ ব্যাংক। নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রির দায়ে জরিমানার মুখে পড়ে একাধিক ব্যাংক। শাস্তি হয় ছয় ব্যাংকের এমডির। সরিয়ে দেওয়া হয় এসব ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের। এমন অস্থিরতায় খোলাবাজারে ডলারের দাম ওঠে ১২৭ টাকায়, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দর।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট চলছে দীর্ঘদিন। এমনকি ডলারের দর নিয়ে কারসাজি করে ১০ ব্যাংক। নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রির দায়ে জরিমানার মুখে পড়ে একাধিক ব্যাংক। শাস্তি হয় ছয় ব্যাংকের এমডির। সরিয়ে দেওয়া হয় এসব ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের। ডলার সংকটের সমাধানে নেওয়া হয় নানান পদক্ষেপ, তবে কোনো পদক্ষেপই কাজে আসেনি। ডলারের দর বেঁধে দেওয়ার কাজটিও ব্যাংকের ওপরে ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও সংকট কাটে না, খোলাবাজারে নগদ ডলারের প্রবাহ থেকেই যায়। ভিন্ন পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমবারের মতো ডলারের দাম তিন ধাপে কমানো হয়। এতে টাকার বিপরীতে ডলারের অবমূল্যায়ন করা হয় কৌশলে। এখন রেমিট্যান্স হিসেবে আসা ডলারপ্রতি গ্রাহক পান ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা।
বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দিতে নানান শর্ত বেঁধে দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। শর্ত পূরণের আলোকেই ২ ফেব্রুয়ারি আসে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার। এরপর দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ পেতে আরও শর্ত জুড়ে দেয় সংস্থাটি। একের পর এক পরিদর্শন, পরামর্শ টিম পাঠানো হয়। ঋণ না পাওয়ার উপক্রমও তৈরি হয়। তবে রিজার্ভ ও রাজস্ব খাতের শর্ত ছাড়া বাকি সব শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ।
এরপর নানান নাটকীয়তা শেষে চলতি ডিসেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার আসে দেশে।
একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক তিনজনে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ এর সংশোধনী অনুযায়ী একটি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে একই পরিবারের সর্বোচ্চ চারজন সদস্য থাকতে পারতেন। ২০১৮ সালে করা এই আইনে পরিবর্তন আনা হয় চলতি বছরের ২১ জুন। জাতীয় সংসদে পাস হওয়া নতুন আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকে এক পরিবারের তিনজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না। চলতি বছর খেলাপি ঋণের রেকর্ড তৈরি হয় দেশের ব্যাংক খাতে। জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এসময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।
আইএমএফের শর্ত ও ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটাতে ৯ শতাংশ সুদহার তুলে ঋণের সুদহারে স্মার্ট পদ্ধতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নতুন এ পদ্ধতি কার্যকর হয় চলতি বছরের জুলাই থেকে। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ তুলে দিয়ে ট্রেজারি বিল, বন্ডের ছয় মাসের গড় সুদহার (ওয়েটেড) বিবেচনা করে প্রতি মাসে একটি রেফারেন্স রেট নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে বাণিজ্যিক ব্যাংক।
দুই বছর আগে মুদ্রাবিনিময় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি ডলার ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কাকে তিন কিস্তিতে এই ঋণ দেয় বাংলাদেশ। ওই বছরের ১৯ আগস্ট প্রথম কিস্তিতে ৫০ মিলিয়ন ডলার, ১১ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তিতে ১০০ মিলিয়ন ডলার এবং সেপ্টেম্বরে ৫০ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়। কোনো দেশকে দেওয়া বাংলাদেশের প্রথম ঋণ এটি। চলতি বছর ওই ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা। চলতি বছর খেলাপি ঋণের রেকর্ড তৈরি হয় দেশের ব্যাংক খাতে। জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এসময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।
আইএমএফের গণনা পদ্ধতিতে দেশের প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হয় চলতি বছরের ১৩ জুলাই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী হিসাবে প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের তারতম্য ছিল। ১৩ জুলাই আইএমএফের গণনা পদ্ধতিতে দেশের রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ওইদিন রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ সূচকে ১২৭ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবের সূচকে এক হাজার ৫৪৬ কোটি ডলারের বড় উদ্বৃত্ত ছিল।
শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাবের স্থিতি ঋণাত্মক। বারবার অবহিত করার পরও ব্যাংকগুলো উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি হিসাবের ঋণাত্মক স্থিতি সমন্বয়ের জন্য ২০ কর্মদিবসের সময় বেঁধে দেয়। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। গত ২৮ নভেম্বর ব্যাংক পাঁচটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৪০ কোটি ডলার ঋণের ওপর ভর করে দেশের রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। এই দুই সংস্থার ঋণ পাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে। তবে খরচ করার মতো রিজার্ভ (বিপিএম৬) আছে ২০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। যদিও আসছে বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আকু (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) পেমেন্ট রয়েছে। সেখানে এক বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করতে হবে।