সাতক্ষীরায় মৎস ঘেরে বোরো চাষে পাল্টে যাচ্ছে জীবনযাত্রা

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: শীত ও কুয়াশাকে উপেক্ষা করে বোরো ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। বিশেষ করে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় মাছের ঘেরে বোরো ধান চাষে অভাবনীয় সাফল্য পাচ্ছে চাষিরা। নিজেদের বুদ্ধি আর প্রকৃতির ঋতুবৈচিত্র্য কাজে লাগাচ্ছে চাষিরা। ঘেরে বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে পাঁচ ছয় মাস চাষ করা হয়। মিষ্টি কুমড়া, জালি, ঢেঁড়স, শসা ক্ষিরা, লাউ ও পুঁইশাকে ভরে যায় ঘেরের আইল। ফলে প্রতি বছর মাছের ঘেরে বোরো ধানের আবাদ বাড়ছে। মাছ ও ধান জেলাকে অনেকখানি সমৃদ্ধ করেছে। বিশেজ্ঞরা জানিয়েছেন, ধানের একক চাষ অপেক্ষা সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে চাষির লাভ ৩ গুণ বৃদ্ধি পায় এবং অধিক উৎপাদনশীলতা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সহজ প্রযুক্তি, কম কার্বন নি:সরণ তথা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হলো মাছের ঘেরে ধান চাষ। দেশের প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই খাতের নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৪ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
সূত্রমতে, আবাদযোগ্য জমি সেচকৃত আবাদি জমি এবং প্লাবনভূমি জমিসমূহ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রায় উৎপাদনশীল করার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আমিষের চাহিদা পূরণ তথা ২০৪১ এর প্রজেকশান নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়নে ধানক্ষেতে মাছ চাষ হতে পারে একটি সহজ কৌশল। দেশে যে পরিমাণ ধানী জমি রয়েছে তার ২.৮৩ মিলিয়ন জমি ধানক্ষেতে মাছ চাষের আওতায় আনা যায় তাহলে প্রতি বছরে ০.৭৩ মিলিয়ন টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হবে। আর্থিক বিশ্লেষণে দেখা যায় সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে চাষির মুনাফা ৬৫.৮% বৃদ্ধি পায়
গত কয়েক বছর ধরে বোরো মৌসুমে মাছের ঘেরে ধান চাষে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহে। তারা বলছে মাছের ঘেরে বোরো ধান ও সবজির সমন্বিত চাষের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষিরা পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। কষ্টের জীবন বদলে অনেকের সংসারে সুদিন এনেছে মাছ ও ধান চাষে। জেলাতে গ্রামের পর গ্রামজুড়ে নিচু জমিতে গড়ে উঠেছে মাছের ঘের। ধান গবেষকরা বলছে ধান গাছের অবশিষ্টাংশ এবং সবজির উচ্ছিষ্টাংশ পচনের ফলে জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেন ও ফসফরাস জাতীয় যৌগ উৎপন্ন হয় যা ঘেরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। এছাড়া মাছের খাবারের উচ্ছিষ্ঠাংশ ও মলমূত্র তলদেশে জমা হয়। তলদেশের জৈব উপাদান সমৃদ্ধ মাটি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ধান ও সবজি চাষ করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃষিনির্ভর উপকূলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য উপখাতের পাশা পাশি বোরোর আবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভবনাময় হয়ে উঠেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। শতভাগ অর্জিত হবে বলে আশা করছেন কৃষকসহ কৃষি কর্মকর্তারা।
সংশৃষ্টরা বলছে, উপকূলীয় অঞ্চলে বোরো ধান চাষে একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো এ মৌসুমে সেচের উৎস নদ-নদী ও খালের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়া। এমনকি মাটি ও নলকূপের পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত শুষ্কতা, তাপমাত্রা, কড়া রোদ ও বৃষ্টিবিহীন অবস্থার কারণে মাটিতে থাকা পানি অধিক হারে বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়ে যায়, অনেক সময় এতে মাটির উপরেও লবণের দানা বা স্তর দেখা যায়। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের ফলে দিন দিন লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। এ অবস্থায় জমিতে পানি ধরে রেখে বা সেচের মাধ্যমে বোরো ধানের চাষ করলে লবণাক্ততা কমে। সেক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে খাল সংস্কার করে সেসব খালে বৃষ্টির পানি মজুদ করে তা দিয়ে বোরো ধানে সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ করলে এসব এলাকার খাল বা নদীর পানিতে অথবা নলকূপের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা সহনীয় থাকে সেসব এলাকায় লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ করে সেচ দিয়ে বোরো ধানের চাষ করা যায়।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মলয় কুমার দে আমিন জানান, ধান গাছের অবশিষ্টাংশ এবং সবজির উচ্ছিষ্টাংশ পচনের ফলে জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেন ও ফসফরাস জাতীয় যৌগ উৎপন্ন হয়, যা ঘেরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। মাছের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ জমির তলদেশে জমা হয়। তলদেশের জৈব উপাদান সমৃদ্ধ মাটি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ধান ও সবজি চাষ করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলাতে লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হতে চলেছে। এছাড়া প্রতিটি উপজেলায় জলবায়ুর ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করে কৃষি, খাদ্য ও অবকাঠামোসহ সবগুলো বিষয় নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে মৎস্য ঘেরে বোরোর আবাদে উৎপাদনে কৃষি খামার বাড়ি কাজ করে যাচ্ছে ।

Please follow and like us:

Check Also

পুষ্টিগুণে ভরপূর কাঁচা আম: ঝড়ের-শঙ্কায় কাঁচা আম ভাঙছে সাতক্ষীরার চাষিরা

আমজাত পণ্য আমদানি বন্ধের দাবী আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ ঝড়ের-শঙ্কা, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি আমের ব্র্যান্ডিং …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।