বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বা লবণাক্ত জলাশয়ময় বন হলো সুন্দরবন, যা প্রকৃতিগতভাবে বাংলাদেশের জন্য এক অপার আশীর্বাদ। জীববৈচিত্র্যের আধার এই বনটি সর্বদাই বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়ংকর সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে আমাদের বাঁচায়। বনটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিপুল কর্মসংস্থান। বুক উজাড় করে বাংলার ভূখণ্ডকে আগলে রাখা সুন্দরবন আসলে কেমন আছে?
সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবন রক্ষায় অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছে বন বিভাগ, এর মধ্যে অন্যতম হলো স্মার্ট পেট্রোলিং সিস্টেম। বলা যেতে পারে, সুন্দরবন রক্ষার্থে অনেকাংশেই সফল এই ডিজিটাল সিস্টেমটি। এ সিস্টেমে বিশেষ সাইবার ট্র্যাকিং প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে সহজ হয়েছে বনকে জলদস্যু ও বনদস্যুমুক্ত করা।
পাশাপাশি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, কুমির, মায়া হরিণসহ বন্যপ্রাণী পাচার ও শিকার, চোরাচালান ঠেকানোও অনেকাংশেই সফল হয়েছে। আগে গহিন বনে চোরাকারবারি চলাকালে অপরাধ চিহ্নিত করতে বনরক্ষীদের অনেক দেরি হয়ে যেত, বর্তমানে স্মার্ট কন্ট্রোলিংয়ের ফলে স্বল্প সময়ে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি চোরাকারবারি রোধে সাহায্য করছে যা আমাদের সুন্দরবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।
তাছাড়াও বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পে বৃদ্ধি পেয়েছে বাঘের সংখ্যা যা সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিকের মধ্যে অন্যতম।
এ প্রকল্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম (ভিটিআরটি) ও কমিউনিটি পেট্রল গ্রুপ (সিপিজি) সদস্যদের সহযোগিতায় বর্তমানে মানুষ ও বন্যপ্রাণীদের মধ্যে সংঘাত অনেকটাই কমে গেছে, বিশেষত আগে গ্রামে কোনো বাঘ ঢুকলেই স্থানীয়রা মেরে ফেলত, কিন্তু বর্তমানে লোকালয়ে বাঘ প্রবেশ করলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভিটিআরটি সদস্যদের ডাকা হয় এবং তাদের সহযোগিতায় বাঘকে আবার বনে ফেরাতে সাহায্য করে। ফলস্বরূপ মানুষের হাতে সুন্দরবনের বাঘ হত্যা অনেকাংশে কমে গেছে।
তবে সুন্দরবন সম্পর্কে বর্তমানে সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, যা চরমভাবে ঝুঁকিতে ফেলেছে সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদকে। বিশেষত, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রধান উদ্ভিদ প্রজাতি সুন্দরী রয়েছে ঝুঁকির শীর্ষে। সুন্দরী স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত লোনা পানি সহ্য করতে পারে না, কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনসহ আরও নানা কারণে সুন্দরবনের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে সুন্দরী নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। সুন্দরীর স্থানে জায়গা করে নিচ্ছি কেওড়া ও গেওয়ার মতো অতিরিক্ত লবণ সহ্যকরী প্রজাতি। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে সুন্দরবনের প্রধান উদ্ভিদ প্রজাতি সুন্দরী বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তাই অতি শিগগিরই সুন্দরী সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এর পাশাপাশি সুন্দরবন রক্ষায় বনজীবীদেরও উৎসাহিত করা যেতে পারে।
বনজীবীদের এ জীবিকা যে শুধু তাদের জীবন চালনার ক্ষেত্রেই সাহায্য করে তা নয়, বরং এগুলো বনের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সাহায্য করে। যেমন, বাওয়ালি-মৌয়ালরা নির্দিষ্ট সময়ে মধু সংগ্রহের ফলে মৌমাছিরা বেশি বেশি মধুর চাক বসায় এবং বনে পরাগায়ন সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে, গোলপাতা আহরণের মাধ্যমে সেটিকে ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, নয়তো গোলপাতাগুলো অযথা নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া গোলপাতা গাছ ছাঁটাই করে না দিলে বৃদ্ধি, ফল ও ফুলের পরিমাণও হ্রাস পায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বনজীবীদের লোভনীয় মনোভাবের কারণে বনের অনেক ক্ষতি হয়।
তাই স্থানীয় পর্যায়ে উচিত বনজীবীদের বনের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝানো এবং সুন্দরবন সংরক্ষণে তাদের উৎসাহিত করা। সর্বোপরি, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতীক হিসেবে সুন্দরবন যেন বুক উঁচু করে বাঁচতে পারে এই হোক সকলের প্রচেষ্টা।
কারিশমা ইরিন
শিক্ষার্থী, বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।