যারা (মন্ত্রী-এমপি) কোনো প্রার্থীর পক্ষ নিয়েছেন, তারা সরাসরি দলের সিদ্ধান্তবিরোধী কাজ করছেন -জাহাঙ্গীর কবির নানক
বলয় ও প্রভাবমুক্ত হচ্ছেই না আওয়ামী লীগের তৃণমূলের রাজনীতি। নিজ নিজ উপজেলার রাজনীতি নিজেদের কবজায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে দলটির স্থানীয় মন্ত্রী-এমপিরা। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নিজ বলয়ের একক প্রার্থীদের সমর্থন দিচ্ছেন তারা। নির্বাচনের আগে এসব মন্ত্রী-এমপির প্রভাবে স্থানীয় অনেক সম্ভাব্য প্রার্থী কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। উন্মুক্ত নির্বাচনে প্রভাবশালীদের এমন হস্তক্ষেপে নাখোশ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক যুগান্তরকে বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে যেসব স্থানে সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীরা সরাসরি কোনো প্রার্থীদের পক্ষ নিয়েছেন, তারা সরাসরি দলের সিদ্ধান্তবিরোধী কাজ করছেন। এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। কারণ এই নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীরা কোনো পক্ষ নিলে আগামী দিনে তাদেরই রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রভাব পড়বে। এর থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে নির্বাচন উন্মুক্ত করা দলীয় সিদ্ধান্ত।
তথ্যমতে, আগামী মে মাসে দেশে অনুষ্ঠিত হবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এবারের উপজেলা পরিষদের ভোট মোট চার ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। সর্বশেষ গত সোমবার দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই ধাপে ভোটগ্রহণ ২১ মে। আর ৮ মে হবে প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ। নির্বাচন সামনে রেখে নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় ব্যস্ত সময় পার করছেন সম্ভাব্য উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তারা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা পরিষদের ভোটে বিএনপি অংশগ্রহণ করছে না-তা প্রায় শতভাগ নিশ্চিত। এমন বাস্তবতায় স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে নিজেদের দলীয় প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির দলীয় প্রতীক নৌকার কোনো প্রার্থী দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে দেশের অধিকাংশ এমপি-মন্ত্রী নিজের পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দিতে শুরু করেছেন। নিজ বলয়ের বাইরে কেউ যেন নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা না করেন, এজন্য স্থানীয় নেতাদের ওপর রয়েছে বাড়তি চাপ। ফলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত-সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিজ বলয়ের প্রার্থী মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থিত নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগার টগর। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে দামুড়হুদা উপজেলায় আপন ভাই আলী মুনসুর বাবুকে চেয়ারম্যান প্রার্থী করেন তিনি। ভোটের মাঠে সরাসরি নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং জয়লাভও করেন। এবারও উন্মুক্ত নির্বাচনে আপন ভাই বাবুকে চেয়ারম্যান পদে সমর্থন করছেন এমপি টগর। ফলে অনেকটাই চাপের মুখে পড়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। নিজের পছন্দের প্রার্থীর নাম ঘোষণা দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান এমপি। কলাপাড়া উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব তালুকদারের নাম ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। মোতালেব উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদেও প্রার্থী দিচ্ছেন মহিববুর রহমান এমপি। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় একক চেয়ারম্যান প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য নাঈমুজ্জামান ভূঁইয়া। চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসাবে কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সহসভাপতি আবদুল লতিফকে সমর্থন দিয়েছেন তিনি।
কক্সবাজার সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীর নাম ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় এমপি সাইমুন সরওয়ার কমল। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম মারুফকে একক প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তার এমন ঘোষণার পরপরই দলীয় কোন্দল সামনে এসেছে। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে দলটির স্থানীয় নেতারা। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে পছন্দের প্রার্থীর নাম ঘোষণা দিয়েছেন রংপুর-২ আসনের এমপি আবুল কালাম মোহাম্মদ আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক। বর্তমান বদরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বী সুইটকে সমর্থন করেছেন তিনি। দলের কর্মী-সমর্থকরা যেন সুইটের পক্ষে নির্বাচন করেন, সেই নির্দেশনাও ইতোমধ্যেই দিয়েছেন।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী দিচ্ছেন জামালপুর-২ (ইসলামপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে মো. আব্দুস ছালামকে চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছেন তিনি। আব্দুস ছালাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। নিজের পছন্দের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাকছুদুর রহমান বসে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। যা নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলায় প্রার্থী দিচ্ছেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। মধুপুরে ইয়াকুব আলী ও ধনবাড়ীতে খালাতো ভাই হারুনুর রশিদকে সমর্থন করেছেন তিনি।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় নিজের পছন্দের প্রার্থীর নাম ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় এমপি মো. শাহাব উদ্দিন। আপন ভাগনে শোয়েব আহমদকে প্রার্থীর ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। শোয়েব উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। নোয়াখালীর হাতিয়ায় ছেলেকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্থানীয় এমপি মোহাম্মদ আলী। ছেলে আশেক আলী ওমিকে প্রার্থী করার কারণে ক্ষুব্ধ দলটির স্থানীয় নেতারা। এমপির ছেলের বিরুদ্ধে নির্বাচন করার সাহস পাচ্ছে না তারা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম যুগান্তরকে বলেন, দলীয় কৌশলের কারণে এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকের প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সেখানে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন। যিনি সাধারণ ভোটারের কাছে বেশি জনপ্রিয় তিনিই নির্বাচিত হবেন। এখানে দলীয় এমপি-মন্ত্রী বা দলের প্রভাবশালীদের পক্ষ নেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা সবাই মিলে সামগ্রিকভাবে আলাপ-আলোচনা করে একজনকে সমর্থন দিতে পারে। সেক্ষেত্রে দল কোনো বাধা দেবে না। কিন্তু এমপি লীগ, মন্ত্রী লীগ, ভাই লীগ, ভাতিজা লীগ, ব্যক্তি লীগ ও পরিবার লীগের নামে নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টির সুযোগ নেই। এমন অভিযোগ পেলে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ নির্বাচনের মাঠে এসব লীগের প্রভাব পড়লের দলের ভেতরে কোন্দলের সৃষ্টি হবে এবং নিজেদের ঐক্য নষ্ট হবে।
টানা চতুর্থ মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ‘গলার কাঁটা’ দলীয় কোন্দল। দ্বন্দ্ব ও কোন্দলে বিভক্ত দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে সদ্যসমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তৃণমূলে এসব সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছেন দলটির বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। চলতি সপ্তাহে রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগের সঙ্গে ইতোমধ্যে বৈঠকও করেছেন তারা। তৃণমূল থেকে আশা অধিকাংশ নেতারাই দলের স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতন, দলের শীর্ষ পদে নিজ বলয়ে লোক বসানো এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে একক প্রার্থী রাখার চেষ্টার বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টিতে আনেন তারা।