বোরো ধানে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র কৃষি প্রণোদনা বৃদ্ধির দাবী

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ বোরো ধানে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র। কারণ দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৫৮ শতাংশ আসে এ মৌসুম থেকে। তাই গ্রাম-বাংলার প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে এখন বোরো কেন্দ্রিক ব্যস্ততা। বোরো ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই, শুকানো, সিদ্ধ করা, ঘরে তোলাসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে কিষান-কিষানিরা। তাই বোরোর ওপর ভিত্তি করেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বলায় গড়ে তুলেছে কৃষকরা। তবে গত বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে প্রায় ২৫ ভাগ বেশি টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে তাঁদের। কৃষকেরা বলছেন, ডিজেল, সার, বীজ, কীটনাশকসহ শ্রমিকের মজুরি খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসাব মতে, চলতি মৌসুমে (২০২৩-২০২৪) বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫০ লাখ ৪০ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে। আর চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে দুই কোটি ২২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৯৬ মেট্রিক টন। যেখানে ১৯৭০-৭১ সালে এ দেশে চালের উৎপাদন ছিল এক কোটি টন। বর্তমানে দেশে যখন জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, তখন চাল উৎপাদিত হচ্ছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টনের বেশি। যার দুই তৃতীয়াংশ অংশ আসে বোরো আবাদ থেকে। যে জমিতে আগে হেক্টর প্রতি দুই থেকে তিন টন ফলন হতো, এখন সেখানে ফলন হচ্ছে ছয় থেকে আট টন। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে কৃষি উৎপাদন বৃিদ্ধর এক চমৎকার সম্ভাবনার দ্বার উন্মেচন করেছে কৃষি সংশ্লিষ্টরা। বোরো ধানের ফলন বেড়েছে আগের যে কোন সয়ের চেয়ে বেশি। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এসব অঞ্চলে বোরো ধানে নতুন নতুন রোগ দেখা দিচেছ। হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। এতে সর্বশান্ত হতে চলেছে কৃষকরা। তবে কৃষিবিদরা বলছে তারা কৃষকের পাশে থেকে সার্বিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

বিআরআরআইয়ের ‘ডাবলিং রাইস”ে প্রাডাকটিভিটি (ডিআরপি) ইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০৩০ সালে দেশে ধানের উৎপাদন ৪০ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন, ২০৪০ সালে ৪৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন ও ২০৫০ সালে ৪৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন টনে উন্নীত করা সম্ভব। ২০৫০ সালে বাংলাদেশকে আনুমানিক ২১ কোটি ৫৪ লাখ লোককে খাবার জোগাতে হবে। চালের বার্ষিক ব্যবহার এখন জনপ্রতি ১৪৮ কেজি। প্রতিবছর তা ০.৭ শতাংশ হারে কমছে। ২০৪০ সালের মধ্যে জনপ্রতি বছরে ১৩৩ কেজি চাল লাগবে। অন্যদিকে প্রতিবছর ধানের উৎপাদন ০.৩৪ শতাংশ হারে বাড়ছে। সবঠিক থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ছিল ৩১৩ দশমিক ১৭ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চালের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৪০১ দশমিক ৭৬ লাখ টনে। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৮৮ দশমিক ৫৯ লাখ টন।
এক সময় উপকূলীয় জেলা সমূহে জলাবদ্ধা ও লবণাক্তাতার কারণে বোরোর আবাদ তেমন দেখা যেত না।কিন্তু সাম্প্রতি বছর গুলোতে লবণসহিষ্ণু জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের মোট লবণাক্ত এলাকার প্রায় ৩৫ ভাগ ধান চাষের আওতায় এসেছে। ফলে দেশে মোট উৎপাদনও বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। জলমগ্নতা–সহনশীল জাত সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২৬ শতাংশ এলাকা চাষের আওতায় এসেছে, যেখানে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯ ভাগ। উপকূলীয় এলাকায় ধানের আবাদ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উদ্ভাবিত জোয়ার-ভাটাসহনশীল জাত (ব্রি ধান-৭৬, ৭৭) উদ্ভাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৫৭ হাজার হেক্টর জমি ধান চাষের আওতায় এসেছে।
গবেষণার রিপোট বলছে, দেশের পাঁচ ভাগের একভাগ মানুষ বাস করে উপকূলীয় ১৪টি জেলায়। দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ৩০ শতাংশ জমি রয়েছে এ অঞ্চলে যার পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ হেক্টর। এ অঞ্চলের মানুষ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দারিদ্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে টিকে বেঁচে থাকতে হয়। বিশেজ্ঞরা বলছে কৃষির অপর সম্ভবনা লুকিয়ে আছে উপকূলীয় অঞ্চলে। তাই এ অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির এক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা দরকার।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামরবাড়ি) তথ্যমতে, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ৭৯ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। খুলনা অঞ্চলের খুলনা বাগেরহাট সাতক্ষীরা ও নড়াইলসহ চার জেলায় দুই লাখ ৫৭ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৯ মেট্রিক টন। এদিকে, চলতি বোরো মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলায় ৪ লাখ কৃষককে কৃষি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। ফলে চলতি মৌসুমে বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচে ২২ থেকে ২৪ মণ ধান পাবে বলে আশা করছে জেলা কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা।
সদর উপজেলার ময়িাসাহেবের ডাঙ্গা গ্রামের কৃষক সুরত আলী জানান, প্রায় ১০বিঘা জমিতে এবার বোরো আবাদ করেছেন। গতবারের তুলনায় ফলনও হয়েছে বেশ ভাল। কয়েকদিন আগে থেকে তিনি ধান কাটা শুরুকরেছেন। তীব্র গরম থাকায় শ্রমিকদের বেশি মুজুরি দিয়ে ধান কাটছেন। গরমে শ্রমিকরা ধান কাটাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকে। এমন বৈরী আবহায়ায় যে কোন সময় প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দিতে পারে। যে কারণে তিনি আগে ভাগেই ধান কেটে ঘরে তুলছেন বলে জানান।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলায় প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে এবার বোরো আবাদে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৭৭১ মেট্রিক টন ধান/চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আশা করা যাচ্ছে এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ছাড়িয়ে যাবে। ধান কেটে ঘরে তোলা পর্যন্ত বড় ধরনের কোন প্রাকৃতি দুর্যোগ না হলে গত মৌসুমের চেয়ে এবার কৃষকরা লাভবান হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, গবেষণা অবকাঠামোর উন্নয়ন, এবং দেশ-বিদেশে বিজ্ঞানীদের উচ্চশিক্ষা, কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ করতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র বদলে যাবে।

 

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।