আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ জোয়র ভাটা ফিরছে সাতক্ষীরা শহরের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত বদ্ধ প্রাণ সায়ের খালে। যুগের পর যুগ কোটি কোটি খনন, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আর ফাইল চালা চালির মধ্যে দখল আর দূষণে হারিয়ে যাওয়া প্রাণ সায়ের খাল তার যৌবন ফিরে পেয়েছে। অন্তবর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের কার্যকরি উদ্যোগ, অবৈধ স্থপনা উচ্ছেদ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পৌরসভা যৌথভাবে কার্যক্রম গ্রহণ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামসিহ বিভিন্ন সংগঠনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে অস্তিত্ব সংকটে থাকা প্রাণ সায়ের খালে এখন বইছে পানির প্রবাহ। কিছুটা হলেও পরিবেশ ফিরে এসেছে খালের দুইপাড়ে। খালপাড়ের রাস্তা দিয়ে এখন নির্বিঘ্নে চলাচল করছেন পৌরবাসী। কমতে শুরু করেছে শহরের জলাবদ্ধতা। এর আগে কয়েক দফায় খালটি খননের নামে কোটি কোটি টাকা অপচয়ের অভিযোগ উঠে। তবে জোয়ার ভাটার কারণে ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে খালপাড়ের রাস্তা।
স্থানীয়রা জানান, ১৮৫০ সালের দিকে সাতক্ষীরার জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরী নদীপথে ব্যবসা—বাণিজ্যের সুবিধা ও শহরের শ্রীবৃদ্ধির জন্য খালটি খনন করেন। মরিচ্চাপ নদের সঙ্গে বেতনা নদীর সরাসরি যোগাযোগ রক্ষার জন্য সাতক্ষীরা শহরের ওপর দিয়ে ১৪ কিলোমিটার এ খাল খনন করা হয়। খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এ খাল। এ খালের মাধ্যমে সহজ হয়ে উঠেছিল জেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও। জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরীর নাম অনুসারে খালটির নামকরণ করা হয় প্রাণ সায়ের খাল।
সাতক্ষীরা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক সরদার সরিফুল ইসলাম বলেন খালটির পাড়ে বা নিকটবর্তী স্থানে কোন ভারী শিল্প—কারখানা না থাকলেও প্রাণসায়ের খাল দখল ও দূষণে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। পৌর শহরের ময়লা—আবর্জনা ফেলার একটি বিশেষ স্থানে পরিণত হয়েছিল খালটি। খালটিতে পানি নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় পৌর শহরের বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। খালটিতে বায়োলজিক্যাল, কেমিক্যাল এরুপ সকল ধরণের বর্জ্য ফেলার ফলে পানির বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ জীবাণু ছড়ানোসহ মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণী সংক্রমিত হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, শহরের বাসাবাড়ী হতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রকার ধোঁয়া মোছার পানি ও পয়ঃবর্জ্য সরাসরি বিভিন্ন ড্রেন হয়ে খালে এসে পড়ছে। খালটির দু’টি মুখ বন্ধ থাকায় অর্থাৎ পানির প্রবাহ না থাকায় এ দূষণ পরিস্থিতি আরো তরান্বিত হতে থাকে। সাতক্ষীরা শহরে কোন কসাইখানা না থাকায় প্রতিদিন শহরের সুলতানপুর বড় বাজারের সকল গরু—ছাগলের উচ্ছিষ্ট বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলা হচ্ছে, যা দূষণের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। শহরের কিছু কিছু রেস্টুরেন্ট এবং মিষ্টির কারখানার তরল বর্জ্য এবং ধোঁয়া মোছার পানি বিভিন্ন ড্রেন হয়ে খালে পতিত হচ্ছে। সাতক্ষীরা শহরে বড় বাজার ও সুলতানপুর কাঁচা বাজারে একটি মাত্র ডাষ্টবিন থাকায় পচনশীল এবং অপচনশীল বর্জ্য একটি বড় অংশ খালে ফেলা হচ্ছিল। খালের দক্ষিণ প্রান্ত কচুরিপানায় পূর্ণ হয়ে থাকাতে পানিতে সূর্যের আলো পৌঁছাতে না পারায় পানির বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছিল।
সরদার সরিফুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের আইন—শৃঙ্খলা সভায় গত চার বছরে বহুবার প্রাণসায়ের খাল দূষণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হলেও কোন কাজ হচ্ছিল না। গত এপ্রিলে জেলা আইন—শৃঙ্খলা কমিটির সভায় পরিবেশ অধিদপ্তর, সাতক্ষীরা জেলা কার্যালয়ের প্রস্তাব মতে প্রাণসায়ের খালের দূষণ রোধকল্পে একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটিতে পরিবেশ অধিদপ্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাণসায়ের খাল সংলগ্ন সুলতানপুর বড় বাজারের (মাছ বাজার, কাঁচা বাজার, মাংসের বাজার) ইত্যাদি বণিক সমিতির সাথে একাধিক বার বৈঠক করে উক্ত বাজার ময়লা—আবর্জনা খালে না ফেলার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয় এবং তাদের সহযোগিতায় উক্ত খালে ময়লা—আর্বজনা অপসারণ করা হয়েছে। খালের দুই প্রান্তে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, জেলা প্রশাসকের সম্মতিক্রমে স্থানীয় অধিবাসীর সহায়তায় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহোযোগিতায় বাঁধ অপসারণ করে খালে জোয়ার ভাটা বা প্রবাহ সৃষ্টি করা হয়েছে। খালের দুই পাড়ে বাসা—বাড়ির ময়লা—আবর্জনা ফেলার জন্য পর্যাপ্ত ডাষ্টবিন স্থাপনের জন্য সাতক্ষীরা পৌরসভাকে অনুরোধ করা হয়েছে এবং ফাঁকা জায়গায় সুন্দরবন ফাউন্ডেশন (এনজিও) নামক সংস্থার মাধ্যমে কিছু বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। বর্তমানে খালটির অবস্থা পূর্বের চেয়ে অনেক ভালো হওয়ায় সাতক্ষীরা জেলা শহরে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন এবং পৌরসভার ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।
২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাষ্টার শফিকুল ইসলাম বলেন, খালটি রক্ষার জন্য গৃহিত কার্যক্রম যথেষ্ট নয়। খালটি রক্ষার জন্য আরো বেশ কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাল পাড়ের এলাকা এবং সুলতানপুর বড় বাজারে পর্যাপ্ত ডাষ্টবিন স্থাপন করতে হবে এবং পৌরসভার কর্তৃক উক্ত ডাষ্টবিন হতে নিয়মিত ময়লা—আবর্জনা অপসারণ করতে হবে। খালপাড়ে পর্যাপ্ত গাছ লাগানো সহ ওয়াকওয়ে নির্মাণ করতে হবে। তাহলে প্রাণসায়ের খালের সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পাবে।
জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘আমরা একটি কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। বিশেষ করে শহরের অংশটুকু সবাই মিলে একটা পর্যায়ে নিয়ে আসবো। তারপর দৃষ্টিনন্দনের জায়গায় আমরা নিয়ে যাবো। সাতক্ষীরা শহরকে দৃষ্টিনন্দন করার জন্য যা যা করার প্রয়োজন তাই করবো।’
আবু সাইদ বিশ^াস
সাতক্ষীরা
০১—০৭—২৫
ক্রাইম বার্তা