সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলে ভাগ্যের চাকা ঘুরছে নতুন এক সম্ভাবনার সঙ্গেÑ কাঁকড়া চাষে। এক সময় যাঁরা জীবিকার জন্য হিমশিম খেতেন, আজ তাঁদের অনেকেই কাঁকড়া চাষ করে স্বাবলম্বী। চিংড়ির ‘সাদা সোনা’র রাজত্ব যে এলাকায় একচেটিয়া ছিল, সেখানে এখন জায়গা করে নিয়েছে ‘কালো সোনা’ খ্যাত সফটশেল কাঁকড়া।
চিংড়ি থেকে কাঁকড়ায় ঝোঁক কেন?
৮০–র দশকে উপকূলজুড়ে চিংড়ি চাষে ছিল ব্যস্ততা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে সঠিক আবহাওয়া না পাওয়ায় চিংড়ির উৎপাদন কমতে থাকে। ঝুঁকি বাড়তে থাকায় চাষিরা নতুন বিকল্প খুঁজতে শুরু করেন। সেই বিকল্প এখন কাঁকড়া চাষ।
এই কাঁকড়া চাষকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক নতুন শিল্প। মুন্সিগঞ্জের কলবাড়ি থেকে নীলডুমুর পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে কাঁকড়া ডিপো, খামার ও ব্যবসা কেন্দ্রের সারি। শুধু স্থানীয় নন, বাইরের লোকজনও এই ব্যবসায় যুক্ত হয়ে নিজেদের জীবিকা বদলে ফেলছেন।
৯ দেশে রপ্তানি হয় উপকূলের কাঁকড়া
উপকূলের ১০ পা বিশিষ্ট কাঁকড়া এখন রপ্তানি হয় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, জাপান, ইউকে, ইউএই, সৌদি আরব, তাইওয়ান, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্তত ২০–২৫ দেশে। সফটশেল কাঁকড়া হিসেবে বিশ্ববাজারে এর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।
সাতক্ষীরা, শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, দেবহাটা ও তালা উপজেলায় হাজারো পরিবার কাঁকড়া আহরণ, সংগ্রহ বা বিপণনের সঙ্গে যুক্ত। অনেক নারী-পুরুষের জন্য এটি এখন প্রধান জীবিকা।
গ্রামজুড়ে কাঁকড়ার রাজত্ব
বুড়িগোয়ালিনী ও নীলডুমুর সড়কের দুপাশ জুড়ে সারি সারি খাঁচা। তার ভেতরে কাঁকড়া। নদীপাড় থেকে শুরু করে গ্রামঘেঁষা জলাশয়Ñ সব জায়গায় ব্যস্ততা কাঁকড়া নিয়ে।
কাঁকড়া চাষি মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমাবশ্যা-পূর্ণিমার সময় কাঁকড়ার ব্যবসা জমে ওঠে। শীতে মাদি কাঁকড়ার চাহিদাও বেশি থাকে। দুই মাস পর পর বিক্রি করি, ভালোই আয় হয়।’
মুন্সিগঞ্জের রঞ্জন ম-লের ১০ কাঠা জমিতে সারাবছর কাঁকড়া চাষ। তিনি বলেন, ‘৫ সদস্যের সংসার আর দুই ছেলের পড়ালেখার খরচ কাঁকড়া চাষ দিয়েই চলে। ৮-১০ হাজার বেকার যুবক-যুবতীর কাজ হচ্ছে এই খাতে।’
কাঁকড়া চাষে চ্যালেঞ্জও আছে
কাঁকড়ার রেণু বা ক্রাভলেট সংগ্রহ এখন বাজার নির্ভর। সুন্দরবনে রেণু কমে আসার আশঙ্কা করছেন চাষিরা। হ্যাচারি না থাকায় উৎপাদন পুরোপুরি প্রকৃতির ওপর নির্ভর।
চাষির ভাষায়, ‘কাঁকড়ার মজুদ নিরূপণ করা গেলে আহরণ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। হ্যাচারি ছাড়া এই খাত স্থায়ীভাবে বাড়ানো কঠিন।’
মৎস্য কর্মকর্তার মতে, ‘হ্যাচারির জন্য মা কাঁকড়া দরকার, যা সুন্দরবনে পাওয়া কঠিন। এছাড়া কাঁকড়ার জন্য ৩০-৩৫ পিপিটি লবণাক্ততা দরকারÑ আমাদের বেশির ভাগ এলাকায় তা নেই।’
ডিজিটাল কাঁকড়া চাষ: উপকূলে নতুন সম্ভাবনা
শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালিত খাঁচাবন্দি কাঁকড়া চাষ। তেলাপিয়া মাছ কেটে দেওয়া হয় খাবার হিসেবে, আর চাষিরা নিয়মিত নজর রাখেন কাঁকড়ার খোলস বদলানোর ওপর। ২০-২২ দিনের মধ্যেই ওজন বাড়লে কাঁকড়া রপ্তানির উপযোগী হয়।
স্থানীয় চাষি মতিউর রহমান বলেন, ‘৬ বিঘা জমিতে কাঁকড়া চাষ করে এখন ভালোভাবেই সংসার চলছে। সমস্যা একটাইÑপানি আর সড়ক যোগাযোগ।’
নারীরাও যুক্ত হয়েছেন এই চাষেÑ কারও কাজ মাছ কাটা, কারও খাঁচা পরিষ্কার, কারও দায়িত্ব কাঁকড়া আলাদা করা।
স্থানীয় যুবক জাফর সাদিক সোহাগ বলেন, ‘গ্রামের মানুষের ভালো কর্মসংস্থান হচ্ছে। নারীরাও আয় করছেন—খুব লাভজনক চাষ।’
উৎপাদন ও রপ্তানি
মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ীÑ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাতক্ষীরা থেকে রপ্তানি হয়েছে ৬৪৪ মেট্রিক টন সফটশেল কাঁকড়া, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। ৩৬৪ জন চাষি জেলার ৩২১ স্থানে এই চাষ করছেন। বছরে উৎপাদন প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মেট্রিক টন।
সরকারি সহায়তা জরুরি
সাতক্ষীরার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জি এম সেলিম বলেন, ‘কাঁকড়া চাষ দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। প্রশিক্ষণ চললেও সবচেয়ে বড় সমস্যাÑ হ্যাচারি নেই। থাকলে সারা বছর উৎপাদন সম্ভব হতো।’
তিনি জানান, সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরণ বছরে পাঁচ মাস বন্ধ থাকে। তাই বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা এবং নিয়মিত সহায়তা দিলে এই শিল্প আরও বিস্তৃত হতে পারে।
শেষকথা
চিংড়ির বিকল্প হিসেবে কাঁকড়া এখন শুধু নতুন সুযোগ নয়Ñ উপকূলের মানুষের জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন আনা এক সম্ভাবনাময় শিল্প। সঠিক পরিকল্পনা, রেণু উৎপাদন ও সরকারি উদ্যোগ জোরদার হলে সফটশেল কাঁকড়া হতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রপ্তানি পণ্য।
ক্রাইম বার্তা