জলবায়ু বদলাচ্ছে, সাতক্ষীরার কৃষকের ভাগ্য বদলাচ্ছে কুলে

সাতক্ষীরা বর্ষা মৌসুমে সাতক্ষীরার নগরঘাটা ইউনিয়নের মিঠাবাড়ি বিলের জমিতে একসময় হাঁটুসমান পানি জমে থাকত। অনিয়মিত বৃষ্টি আর আকস্মিক জলাবদ্ধতায় বারবার ধান চাষ করে লোকসানের মুখে পড়ছিলেন স্থানীয় কৃষক পাঞ্জাব আলী বিশ্বাস। পাঁচ বছর আগে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তিনি বেছে নেন বিকল্প পথ। কৃষি অফিসের পরামর্শে জমিতে উঁচু ঢিবি তৈরি করে লাগান কুলের চারা। প্রথম মৌসুমেই বাজিমাত! এখন তাঁর ১২ বিঘা জমির পুরোটাই কুলের বাগান, যা তাঁকে এনে দিয়েছে অভাবনীয় সচ্ছলতা।

পাঞ্জাব আলীর এই বদলে যাওয়ার গল্প আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সাতক্ষীরার কৃষকদের অভিযোজনের এক বাস্তব চিত্র। অনিয়মিত বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে ধান ও সবজি চাষ যখন ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, তখন উপকূলীয় এই জেলার কৃষকেরা কুল চাষে দেখছেন নতুন সম্ভাবনা।

দেড়শ’ কোটি টাকার হাতছানি সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৮৪৬ হেক্টর জমিতে কুলের আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর জেলায় ১৫০ থেকে ১৬০ কোটি টাকার কুল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে কলারোয়ায় (৪৭২ হেক্টর)। এ ছাড়া তালায় ১৬৫ হেক্টর ও সাতক্ষীরা সদরে ১১২ হেক্টর জমিতে কুলের বাগান করা হয়েছে।

জলাবদ্ধতা সামলাতে ‘বেড’ পদ্ধতি বর্ষায় পানি জমার ঝুঁকি এড়াতে কৃষকেরা এখানে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। জমি প্রস্তুতির সময় গাছের গোড়া আড়াই থেকে তিন হাত উঁচু করে ‘বেড’ বা ঢিবি তৈরি করা হয়। চারপাশ দিয়ে নালা কেটে রাখা হয় দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে পলিথিন বা মালচিং পদ্ধতিও ব্যবহার করা হচ্ছে।

মিঠাবাড়ি এলাকার চাষি দাউদ আলী বলেন, “অতিবৃষ্টির আশঙ্কায় আমরা আগে জমি উঁচু করি এবং জলসহিষ্ণু জাতের চারা লাগাই। এতে ফলন ভালো হয়, গাছেরও ক্ষতি হয় না।”

বাজারে কুলের কদর সাতক্ষীরার কুল এখন দেশজুড়ে সমাদৃত। বিশেষ করে মিঠাবাড়ির নারিকেল কুল, টক কুল, থাই আপেল কুল ও বল সুন্দরীর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি কুল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে নারিকেল কুলের দাম স্থানীয় বাজারে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা এবং ঢাকায় ২৫০ টাকা পর্যন্ত উঠছে। কৃষকদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে প্রায় ১০০ মণ কুল উৎপাদন হচ্ছে।

এক জমিতে একাধিক ফসল সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, কুল চাষের বড় সুবিধা হলো ফল সংগ্রহ শেষ হলে একই জমিতে ওল বা বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষ করা যায়। ফলে কৃষকেরা একই জমি থেকে একাধিক ফসলের মুনাফা পাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে সাতক্ষীরার কুল রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। অতিবৃষ্টি আর জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সাতক্ষীরার এই কুল চাষ এখন সারা দেশের কৃষির জন্য একটি সফল ‘অভিযোজন মডেল’ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।

About news-admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *