সাতক্ষীরায় সমন্বিত সবজি চাষে সম্ভাবনার হাতছানি বাড়ছে ঘেরের আইলে বার মাসি সবজি চাষ

আবু সাইদ বিশ্বাস. সাতক্ষীরাঃ সাতক্ষীরায় মাছের ঘেরের অনাবাদি আইলে সবজি চাষে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের। ইতিমধ্যে ঘেরের আইলে সবজি চাষ করে কৃষকরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। ঘেরে চিংড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাদা মাছের চাষ। আর সাদা মাছ চাষ হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে ঘেরের আইলে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ। ঘেরের আইলে সবজি আর নিচে পানিতে মাছ। চাহিদা বাড়ায় ক্রমেই বাড়ছে এই চাষ পদ্ধতি। ফলে জেলা ব্যাপি সমন্বিত সবজি চাষে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। অধিকাংশ মৎস্য ঘেরগুলোতে যতদূর চোখ যায় সবুজের হাতছানি। মাছের ঘেরের আইলে বিশেষ পদ্ধতিতে বাঁশ ও জাল দিয়ে ঝুলন্ত মাচা তৈরি করা হয়েছে। তারপর সবজির আবাদ করে বাড়ন্ত গাছ মাচার ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে জায়গা কম লাগে ও অল্প পরিচর্যায় ভালো ফসল পাওয়া যায়। দেখা গেছে, ঘেরের আইলের উপরে নির্মিত সারি সারি মাচায় ঝুলছে করলা, লাউ, কুমড়া, বরবটি, চিচিংগা, ধুন্দল আর শসা। আইলে উপরে রয়েছে ঢেঁড়শ, পুঁইশাক ও কলাগাছ। মাচায় ঝুলছে লাভজনক সমন্বিত সবজির ফসল। টানা বৃষ্টিতে জেলাব্যাপি সবজির ব্যাপক ক্ষতি হলেও সপ্তাহখানিকের মধ্যে ঘেরের আইলে চাষকৃত সবজি বাজারে পূর্ণমাত্রায় উঠলে সবজির দাম কমে যাবে।

চোখ যেদিকে যায় তাকালেই শুধু পানি আর পানি বিস্তৃত জলভূমি। পানিতে থৈ থৈ করলে ও ঋতু বৈচিত্র্য আর বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, লবণাক্ততা, লোনা পানির চিড়ি চাষ, জলাবদ্ধতা এসব পরিবর্তনের ফলে এই এলাকায় এখন দেখা যায় নিচে পানিতে মাছ, ডাঙায় আইল/বেড়িবাঁধে বিস্তীর্ণ সবজি চাষ হচ্ছে। পানির সাথে সাথে দেখা মিলছে সবুজে ভরা নানান ফলমূলেরও। সবুজের সমারোহে এক খন্ড জলরাশিতে সূর্যের কিরণে যেন চিকচিক করছে পুরো ঘের।

জানা যায়, মাছের ঘেরের আইলে বিশেষ পদ্ধতিতে বাঁশ ও জাল দিয়ে ঝুলন্ত মাচা তৈরি করা হয়। তারপর বিষমুক্ত সবজির আবাদ করে বাড়ন্ত গাছ মাচার ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে জায়গা কম লাগে ও অল্প পরিচর্যায় ভালো ফসল পাওয়া যায়। মৌসুমী ধান ও মাছ চাষ করে একসময় যাদের পরিবার—পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটত, লাভজনক সমন্বিত সবজি চাষে এখন তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। ‘অল্প পুঁজিতে অনেক লাভের ফলে উৎসাহিত হয়ে এখন সমন্বিত এই চাষের দিকে ঝুঁকছেন অনেকেই।

জেলার বিভিন্ন জায়গার সবজি চাষিরা জানান, বর্তমানে দেশে ও বিদেশে সবজির ব্যাপক চাহিদা হওয়ায় গতকয়েক বছরে জেলার মাছের ঘেরের আইলে সবজি চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে মাছের ঘেরে মাচা পদ্ধতিতে সবুজ সবজির চাষ কৃষিতে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছেন দাবি করে তারা বলেন, মাচা পদ্ধতিতে সবজি চাষে বদলে গেছে তাদের মতো জেলার বহু কৃষকের ভাগ্য। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ছোঁয়া লেগেছে এখানকার কৃষিকাজেও। ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন প্রকল্পের আওতায় ‘পলিনেট হাউজ পদ্ধতি’ ব্যবহার করে কৃষিতে নবদিগন্তের সৃষ্টি করেছে জেলার অনেক কৃষক।

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কাটখালী গ্রামের আনসার আলী বলেন আমার ১২বিঘা জমির ঘের এই ঘরের চতুর্পাশের সব আইলে সবজি চাষ করেছি এর মধ্যে রয়েছে করলা লাউ পুঁইশাক মিষ্টি কুমড়া ঝিঙ্গা তরল ভেন্ডি সহ আরও কয়েক প্রজাতির সবজি । কালিগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের রঘুনাথ মন্ডল বলেন তার ৮ বিঘা জমির ঘেরে চতুর্পাশে জাল টানিয়ে সবজি চাষ করেছেন এবং এক সপ্তাহ জুড়ে সবজি বিক্রয় করছেন দামেও ভালো পাচ্ছেন । দেবহাটা উপজেলার সখিপুর গ্রামের রেজাউল করিম বলেন তার ২৮ বিঘা জমির ঘেরে চতুর্পাশে জাল টানিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির সবজি চাষ করেছেন তিন থেকে চার দিনের মধ্যে এই সমস্ত সবজি বাজারে তুলতে পারবেন বলে জানান রেজাউল করিম ।

সাতক্ষীরার কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) প্রচেষ্টায় বিগত কয়েকবছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মাছের ঘেরের ভেড়িতে (বাঁধে) সবজি চাষ। ‘সাথী ফসল’ হিসেবে শুরু হলেও এখন মূল ফসলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে সমানে সমান। জেলায় বছর প্রতি যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে তার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ঘেরের আইলে ও মাচা পদ্ধতিতে। ঘেরের আইলে সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় জেলার অধিকাংশ সাদা মাছের ঘেরে সবজির চাষাবাদ দিন দিন বাড়ছে। সাতক্ষীরা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর (খামারবাড়ি) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলার ৮৭৫ হেক্টর জমির (মাছের ঘেরের ভেড়ি) আইলে বিভিন্ন প্রকারের সবজি চাষ হয়েছে।

নগরঘাটা ইউনিয়নের গাবতলা গ্রামের জফর সরদারের ছেলে ইসরাইল হোসেন জানান, তিনি ১৬ একর জমিতে মৎস্য ঘের করেছেন। তার তিন পাশে সবজি চাষ করেছেন। তার ১৬ একর জমির তিন পাশের সবজি চাষে সবমিলে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার মত খরচ হয়েছে। যেখান থেকে সবজি পাওয়ার সময় চলে এসেছে কম—বেশি।

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মৎস্য ঘেরের বাঁধে সবজি চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কমপক্ষে ২৫ হাজার মাছচাষী ঘেরের বাঁধে সবজি চাষ করেন। এতে তাদের আলাদা কোনো জমি দরকার হয় না, বরং বাঁধের পতিত জমি কাজে লাগিয়ে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে সবজি উৎপাদন করে বাড়তি আয় করছেন। এসব সবজির বাজার দাম ১০০ কোটি টাকারও বেশি।’

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ এই বলেন, বিগত কয়েক বছরে মাছের ঘেরের আইলে সবজি চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে সাতক্ষীরায়। আর পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় অতিতের তুলনায় ভবিষ্যতে আরও কৃষি বিপ্লব ঘটবে এ অঞ্চলে। তাঁর মতে, সাতক্ষীরা সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ির রাজধানী হিসেবে পরিচিত থাকলেও সবজি উৎপাদনে এ জেলার আলাদা একটি সুনাম রয়েছে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ সবজি রাজধানীসহ পদ্মার ওপারের বিভিন্ন জেলায় যায়। তিনি আরো বলেন,কৃষকদের জন্য যা যা করা দরকার সরকার তাই করবেন।

আবু সাইদ বিশ^াস
সাতক্ষীরা
১২/৮/২৫
০১৭১২—৩৩৩২৯৯

 

About news-admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *