রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় জামায়াতের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলটির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি সংস্কার, নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিবেদক সেলিম জাহিদ ও জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রিয়াদুল করিম।
সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করল। সংলাপে আপনি জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনার অভিজ্ঞতা কী?
আবদুল্লাহ মো. তাহের: বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে সংস্কার কমিশনের ৩০-৩২টি দলের সম্মিলিত মিটিং এটি প্রথম এবং একটি যুগান্তকারী ঘটনা। যেখানে ডান, বাম, মধ্যমপন্থী এবং ইসলামপন্থী লোকদের খুব বেশি ইন্টারেকশন হতো না, আমরা একে অন্যকে জানতাম না। কমিশনের এই উদ্যোগটা এদিক থেকে সফল হয়েছে। নানা মতের-পথের লোকদের জানার সুযোগ হয়েছে, একধরনের রিলেশন তৈরি হয়েছে। এদিক থেকে এটাকে আমি খুবই ইতিবাচক মনে করি। তবে (আলোচনার জন্য) দল সিলেকশনের ক্ষেত্রে কিছুটা অপরিপক্বতা ছিল বলে আমি মনে করি। যে কারণে কোনো একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: ফলাফলের ক্ষেত্রে একটা পর্যায় আমরা সফলভাবে পেরিয়ে এসেছি। মৌলিক অনেকগুলো বিষয়ে আমাদের মধ্যে হাজারো মতাদর্শগত পার্থক্যের পরও এক জায়গায় আসতে পারছি। সুতরাং এই পর্বটাকে আমি সফল মনে করি।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: আমরা পুরো ডিসকাশনে (আলোচনায়) একটা বিষয় লক্ষ করেছি, বিএনপির পক্ষ থেকে সংস্কারের প্রশ্নে কিছুটা অনীহা ভাব দেখেছি। তারপরও আমি তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই, শুরুতে যতটুকু অনীহা ছিল, সেটা পরিহার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে অনেক বিষয়ে তারা কিছুটা লিনিয়েন্সি শো (উদারতা প্রদর্শন) করেছে। তারা মেজরিটি অপিনিয়নকে অ্যাকসেপ্ট করেছে উইথ নোট অব ডিসেন্ট। এটা আমি মনে করি একধরনের পজিটিভ স্ট্যান্ড। কারণ, নোট অব ডিসেন্ট আপনি দিতে পারেন, কিন্তু মূল বিষয়ে ঐকমত্যের ক্ষেত্রে আপনি একমত ছিলেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া হয়েছে, এগুলোর বাস্তবায়নে কী হবে? আমি ল ইয়ারদের সঙ্গেও কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, মেজরিটি পিপল যেটাকে অ্যাকসেপ্ট করে, সেটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। নোট অব ডিসেন্ট ইজ ফর রেকর্ড। এটা কিন্তু আইনি ভিত্তি বা ওই ধরনের কোনো গুরুত্ব বহন করে না। যেমন হাইকোর্টে তিন বিচারকের বেঞ্চ আছে। সেখানে দুই বিচারক এক বিষয়ে একমত, আরেকজন দ্বিমত পোষণ করেন। দুজনের ভিত্তিতে রায়টা হয়। আরেকজনেরটা শুধু তাঁর ডিফারেন্ট অপিনিয়ন হিসেবে রাখা হয় রেকর্ডে।
আমরা পুরো ডিসকাশনে (আলোচনায়) একটা বিষয় লক্ষ করেছি, বিএনপির পক্ষ থেকে সংস্কারের প্রশ্নে কিছুটা অনীহা ভাব দেখেছি। তারপরও আমি তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই, শুরুতে যতটুকু অনীহা ছিল, সেটা পরিহার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে অনেক বিষয়ে তারা কিছুটা লিনিয়েন্সি শো (উদারতা প্রদর্শন) করেছে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: এই কথাটা আমি একেবারে উড়িয়ে দিতে চাই না। কিন্তু আপনি যখন একটা মিটিংয়ে বসবেন, সেখানে সবাই যদি ইকুয়াল মেম্বার হয়, তাহলে ডিসিশনের ক্ষেত্রে তো সংখ্যাগরিষ্ঠতাই প্রাধান্য পাবে। হোয়েন ইউ সিট ইন ওয়ান মিটিং, ইউর পজিশন অ্যান্ড মাই পজিশন, অ্যান্ড আদারস পজিশন ইজ ইকুয়াল। অ্যান্ড এভরি পার্টিসিপেটরি পার্টি হ্যাজ গট হিজ ওয়ান সিঙ্গেল ভোটস অর অপিনিয়ন ইকুয়াল টু এভরিওয়ান। সুতরাং এখানে জনপ্রিয়তা কার বেশি, কার কম, কে কত ভোট প্রতিনিধিত্ব করে না করে—এটার কোনো ইন্ডিকেশন তো ওই মিটিংয়ের ভেতরে ছিল না। সুতরাং এ কথাটা থিওরিটিক্যালি অথবা প্র্যাকটিক্যালি হলেও অফিশিয়ালি ইউ ক্যান নট সে লাইক দিস।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: বিস্ময় তো সেখানেই। সংস্কার যেখানে বিএনপির প্রস্তাব ছিল দুই বছর আগেই, কিন্তু যখন সংস্কার করার বাস্তব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেখানে তারা আগের ঘোষণা থেকে নিজেরাই সরে গেছে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: কে ক্ষমতায় যাবে, আই ডোন্ট নো। কোনো একটা দল নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার পর ওইখানে যদি এ কথা বলে, তাহলে তারা এটাও তো বলতে পারে যে আমি যা-ই আগে বলছি, এখন মানি না। এটা অঙ্গীকারের ব্যত্যয় হবে। আমরা তো সেটাই বলছি, এই জায়গাটাতেই একটা গুণগত পরিবর্তন আসতে হবে।
জুলাই চার্টার একটা প্রস্তাব। আর আমরা তার সঙ্গে যোগ করব পিআর (সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি)। সুতরাং দুইটা পয়েন্টের ওপর গণভোট হতে পারে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: আমাদের অবস্থান একেবারেই আগের মতো। এখন আইনি ভিত্তি দেওয়ার যে প্রশ্নটি এসেছে, যেগুলোতে আমরা সম্মত হয়েছি এবং যেগুলোতে মৌলিকভাবে ঐকমত্য হয়নি—সবকিছু মিলেই আমরা গণভোটের পক্ষে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: না, এটা একটা প্যাকেজ প্রস্তাব। জুলাই চার্টার একটা প্রস্তাব। আর আমরা তার সঙ্গে যোগ করব পিআর (সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি)। সুতরাং দুইটা পয়েন্টের ওপর গণভোট হতে পারে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: যখন ঐকমত্য কমিশন লিখিতভাবে আমাদের অনেকগুলো প্রস্তাব দিয়েছিল প্রথম ধাপে। সেগুলোর লিখিত জবাবে আমরা উভয় কক্ষেই পিআর চেয়েছি। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন শুধু উচ্চকক্ষে পিআর নিয়ে একটা প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। সেখানে শুধু কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত বিষয়ের ওপর আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সে আলোচনায় পিআর নিয়ে আমি কমপক্ষে তিনবার কথা বলেছি। অন্য দলগুলো বলেছে, ইসলামী আন্দোলন লিখিতভাবে দিয়েছে। সুতরাং আমরা জোরালোভাবে বলিনি, এটা এ রকম নয়। এটা হতে পারে, আমরা ভায়োলেন্ট হইনি।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: আমরা মনে করি, পিআর পদ্ধতি দেশের জন্য কল্যাণকর। আমাদের দাবির মাধ্যমে এটা পূরণ হবে এবং সেই ভিত্তিতে নির্বাচন হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তা অতীতের মতোই হবে। কেন্দ্র দখল হবে, ব্যালট পেপার ছিনতাই হবে, রাতের ভোট হবে, পারসেজ (কেনাবেচা) হবে। নতুন পিআর পদ্ধতি যদি হয়, তাহলে কেন্দ্রে মাস্তানি হবে না, কালোটাকার ছড়াছড়ি, ভোট কেনার হিড়িক হবে না।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: দুইটা হতে পারে। পিআর ঐকমত্য কমিশনের বাইরেও একটা এজেন্ডা হতে পারে। আমরা সে ভিত্তিতে আলোচনার জন্য সরকারের কাছে বলছি।
আমরা এটা চাই কেন? তিনটি কারণে চাই। প্রথম কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষিত। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো নজির নেই। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় যে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট হয়েছিল, সেখানেও ৯৯ পার্সেন্ট ভোট কাস্ট হয়েছে। এটা অ্যাবসার্ট।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: তিনটা নির্বাচন অপেক্ষাকৃত ভালো। রিলেটিভলি (তুলনামূলকভাবে) ওকে, কিন্তু ফেয়ার না। আমি তো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি, আমি জানি বাস্তব পরিস্থিতি। এটা একটা কারণ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তা অতীতের মতোই হবে। কেন্দ্র দখল হবে, ব্যালট পেপার ছিনতাই হবে, রাতের ভোট হবে, পারসেজ (কেনাবেচা) হবে। নতুন পিআর পদ্ধতি যদি হয়, তাহলে কেন্দ্রে মাস্তানি হবে না, কালোটাকার ছড়াছড়ি, ভোট কেনার হিড়িক হবে না। পিআর পদ্ধতিতে যদি ভোট হয়, তাহলে কেন্দ্রে মাস্তানি হবে না। একটা স্মুথ ভোট হবে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: এখানে কোনো দলের জিম্মি হওয়ার কোনো বিষয় নয়। কারণ, আপনার জনপ্রিয়তা যদি এত বেশি থাকে, তাহলে পিআর পদ্ধতিতে তো আপনি মেজরিটি সিট পাবেন। আপনার যদি ফিফটি পার্সেন্ট জনপ্রিয়তা থাকে, তাহলে তো আপনি ১৫০ সিট পাচ্ছেন। এখানে তো জিম্মি হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর আপনি যদি এত বড় জনপ্রিয় দল না হন, তাহলে আপনি একাই কেন ক্ষমতা বহন করবেন?
এ ছাড়া এটাকে আমি ছোট দলগুলোর কাছে জিম্মি হওয়া নয়, বরং এটাকে আমি পার্টিসিপেটরি গভর্ন্যান্স মনে করি। আমরা যে বলছি, ফ্যাসিবাদ আর আসতে পারবে না। ফ্যাসিবাদ তো দমন হলো, প্লাস আরও দলগুলো যারা মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করে, তাদের অংশগ্রহণে একটা গভর্ন্যান্সের সুযোগ তৈরি হবে পিআর পদ্ধতিতে। সুতরাং যারা বলছে জিম্মি হবে, ওদের কনসেপ্ট আর আমরা যারা বলি পার্টিসিপেটরি গভর্ন্যান্স হবে, এই কনসেপ্টটাই তো ভিন্ন।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: আমি তো বলেছি, আমাদের দাবি আদায় করে নির্বাচন হবে। আমরা মনে করি, সংস্কারবিহীন নির্বাচন দেশকে আওয়ামী জাহেলিয়াতের সে অন্ধকারের দিকেই নিয়ে যাবে। এখন যদি আবার ও রকমই একটা নির্বাচন হয়, তাহলে তো তার পরিত্রাণ হলো না, বরং আমরা নতুন সমস্যা তৈরি করলাম। সুতরাং আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, আমরা নির্বাচনে যাব কি না—এখন এটা প্রশ্ন নয়। এখন জাতির কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, সংস্কার হচ্ছে কি হচ্ছে না। এখানেই মূল বিবাদ। একটি বড় দল সংস্কার চায় না, আর সব স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) সংস্কার চায়। সুতরাং মেজরিটি পিপল যে সংস্কার চাইছে এবং এই সরকারেরও অঙ্গীকার সংস্কার, জুলাইয়েরও অঙ্গীকার সংস্কার—সেটা তো আগে ঠিক করতে হবে।
এখানে এই সরকারের ত্রুটির কথা আমি বলব। নির্বাচনের আগে যে কাজগুলো করণীয়, সেগুলোর ব্যাপারে সরকার কথা বলছে না। সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই একটি দলের অংশ হয়ে বাকি দলগুলোকে ডিফেন্সে ফেলে দিয়েছে। যেমন বিএনপি বলছে, নির্বাচন হয়ে যাবে, আর কোনো কথা নেই। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, সংস্কার হতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ক্ষেত্রে একটা রাজনৈতিক ইমব্যালেন্স (ভারসাম্যহীনতা) তৈরি করা হয়েছে। আগে তো এটা অ্যাড্রেস করতে হবে। এখন আপনাকে দুই হাত এগিয়ে দিয়ে যদি বলে যে দৌড় প্রতিযোগিতা। আপনি দুই হাত আগে আছেন, আমি তো দুই হাত পিছে আছি। এখন যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, দৌড়ে অংশ নেবেন কি, নেবেন না। এর অর্থ কী এই বোঝাবে, আমি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে চাই না? এখানে যেটা করতে হবে পরিষ্কার করে বলছি, যারা রাষ্ট্র নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে, সংস্কারবিহীন নির্বাচন তাদের ঘাড়ে চড়ে বসেছে। সংস্কারবিহীন নির্বাচন মানে নতুন বাংলাদেশ গড়ার বিরুদ্ধে একধরনের ষড়যন্ত্র। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে নতুন বাংলাদেশ, নতুন প্রেক্ষিত এবং নতুন পদ্ধতিতেই নির্বাচন হতে হবে।
আমরা মনে করি, সংস্কারবিহীন নির্বাচন দেশকে আওয়ামী জাহেলিয়াতের সে অন্ধকারের দিকেই নিয়ে যাবে। এখন যদি আবার ও রকমই একটা নির্বাচন হয়, তাহলে তো তার পরিত্রাণ হলো না, বরং আমরা নতুন সমস্যা তৈরি করলাম।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: সে জন্য আমরা আন্দোলনে যাব যদি প্রয়োজন হয়। হয় আমাকে দুই হাত এগিয়ে দিতে হবে, না হয় যেটারে আগাইছে, সেইটারে দুই হাত পিছাইয়া দাঁড় করাইতে হবে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: জুলাই ঘোষণা নিয়ে আমাদের আপত্তি ছিল, আপত্তি আছে এবং বাংলাদেশের মানুষের আপত্তি আছে। আপনি বলবেন এটা বুঝলেন কেমনে? দেখুন, জুলাই ঘোষণাকে কেবল বিএনপি অভিনন্দন জানাইছে, আর কেউ কিন্তু অভিনন্দন জানায়নি। সবাই বলেছে, (জুলাই ঘোষণাকে) ইতিবাচকভাবে দেখতেছি, আমরাও বলেছি। এরপর কিন্তু তবে তবে তবে। অর্থাৎ মেজর পলিটিক্যাল পার্টিগুলো এটার ভেতরে ‘তবে’ লাগিয়ে রাখছে। আমরা এটা নিয়ে ভায়োলেন্ট হইনি। আমরা একটা অর্জন করেছি জুলাইতে, সেই অর্জনটাকে আমরা পাবলিকলি ম্লান করে দিতে চাইনি। এটা আমাদের ধৈর্যও বলতে পারেন, আমাদের উদারতাও বলতে পারেন।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: আমরা মনে করি, এটা গ্রহণযোগ্য। কারণ, আমাদের সংবিধানই বলছে পিপলস উইল ইজ সুপ্রিম। সুতরাং জুলাই চার্টার যেটা তৈরি হচ্ছে, এটা জনগণের মতামতেরই একটা প্রতিফলন। সুতরাং এটা অ্যাভাব কনস্টিটিউশন (সংবিধানের ওপরে) হতে আমি কোনো আপত্তি দেখি না স্পিরিটের দিক থেকে।
আরেকটা দিক বলি, বর্তমান যে অন্তর্বর্তী সরকার, এই সরকারের কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে? এটা কি সংবিধানে উল্লেখ আছে? ইলেকশন কমিশন ব্যাপারে কি সংবিধানের উল্লেখ আছে? আমরা তো এটা মানতেছি। কেন মানছি? ডকট্রিন অব নেসেসিটি। দিস ইজ উইল অব দ্য পিপল। কেন মানছি? এটা আমাদের আন্দোলনের ফসল। আপনি যদি সরকারকে এভাবে মানতে পারেন, জুলাই চার্টারকে আপনি এই স্পিরিটে মানতে পারবেন না কেন?
আবদুল্লাহ মো. তাহের: মানুষের ফ্রিডম অব স্পিচে আমরা বিশ্বাস করি। উনি ওনার কথা বলেছেন। তবে উনি যা বলছেন, সেটা ঠিক নয়। কারণ, ২০০৮ সালের পর যে তিনটি নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে, সেখানে তো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর কোনো কারণ নেই। উনি যদি সেই তিনটি নির্বাচনকে জনগণের মতের প্রতিনিধি হিসেবে ধরে নেন, তাহলে বুঝতে হবে উনি ফ্যাসিবাদ আর স্বৈরাচারকেই মূলত সার্টিফাই করছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওনাকে যতটুকু জানি, ওনার সঙ্গে এটা মানায় না। কারণ, আমরা যে ৩০টা দল এখানে একত্র হয়েছি, এখানে ছোট দল আছে, বড় দল আছে। এখানে শুধু একটি দল এবং দোসরদের মাইনাস করে পুরো জাতিকে রিপ্রেজেন্ট করছে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়। সুতরাং এটা নিঃসন্দেহ মেজরিটিকে রিফ্লেক্ট করে।
আমি বলছি না, বিএনপি ক্ষমতায় যাবে না। কিন্তু আমি এটা বলি না যে বিএনপি যাবে। আমি এটাও বলছি না যে জামায়াত যাবে। এটাও বলছি না যে জামায়াত যাবে না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় যে বিএনপি ছিল, এটা বিশাল সংগঠন ছিল, জনপ্রিয় ছিল। এখন বিএনপি বিশাল সংগঠন, কিন্তু জনপ্রিয় নয়; এটা বাস্তবতা।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: জুলাই সনদের মূল জিনিসটা কী, সেটা আগে বলি। ইমানের যেমন তিন অংশ। একটা হচ্ছে মুখে স্বীকার, তারপর হৃদয়ে ধারণ, এরপর সেটি কাজে পরিণত করা। জুলাই সনদেরও আমি তিনটা অংশ দেখি। একটা হচ্ছে ঐকমত্য হওয়া। দুই হচ্ছে আইনি ভিত্তি দেওয়া। তিন হচ্ছে সেই ভিত্তিতে এটাকে বাস্তবায়ন করা। এখন পর্যন্ত আমরা শুধু একটা জায়গায় ঐকমত্য পোষণ করেছি বিভিন্ন ইস্যুতে। এটাকে আমি জুলাই সনদ বলব না। বাকি দুইটা যখন ইমপ্লিমেন্টেড হবে, তখন পুরোটা মিলে জুলাই সনদ হবে।
এখন কী পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটার জন্য তিনটা পদ্ধতি হতে পারে। একটা, লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক। এর মাধ্যমে কনস্টিটিউশন অ্যসেম্বলি তৈরি হতে পারে। এবং সেটি হবে জুলাই সনদের ওপর ভিত্তি করে। এটাকে রেটিফাই (অনুমোদন) করতে হবে। দুই নম্বর হচ্ছে প্রক্লেমেশন বাই প্রেসিডেন্ট। এটা কিছুটা দুর্বল হয়, কিন্তু পরে রেটিফাই করলে কোনো সমস্যা হয় না। সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে গণভোট। গণভোট হলে এখানে বিতর্কের সুযোগ নেই। আমরা মনে করি, গণভোটে চলে যাওয়া উচিত সময় নষ্ট না করে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: অবশ্যই। কারণ, গণভোটের মাধ্যমে তো এগুলো সিলেক্টেড হবে। আমরা যে পিআর বলছি, এটা তো নতুন বাংলাদেশের জন্য। আমরা এটাও গণভোটে চাই।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: এতে বেশ কিছু জটিলতা আছে। এগুলো যাঁরা বলছেন, তাঁরা একটা হাইপোথিটিক্যাল চিন্তা করছেন।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: আশঙ্কা উড়িয়ে দিই না। সবাই বলছে সংস্কার প্রয়োজন, বিএনপিও বলছে। বিএনপি যদি সংস্কার ব্যাপারে একমত না থাকত একেবারেই, তাহলে তো তারা আলোচনায় আসত না। সংস্কার যদি উনারা চান, তাহলে সংস্কারের আইনি ভিত্তি দিতে অসুবিধা কোথায়? আর আইনি ভিত্তি যদি দেওয়া যায়, তার ভিত্তিতে নির্বাচন হইতে অসুবিধা কোথায়? এ প্রশ্নগুলো আমাদের শঙ্কা তৈরি করছে যে কোনো মোটিভেটেড জায়গা থেকে এসব রিজিটিডি (অনমনীয়তা) আরোপ করে নির্বাচনটাকেই ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা আছে কি না।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: বাংলাদেশের একটা বড় দিক হচ্ছে ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব। স্বৈরাচার তো আমরাই তৈরি করেছি, এই সিস্টেম তো আমরাই তৈরি করেছি। সব কাজ, সব ক্ষমতা একজনের হাতে। বিএনপি যে আশঙ্কা করছে, এটা একটা স্বৈরাচারী মনোভাব থেকে এই আশঙ্কাটা বিরাজমান এবং এটা হতে পারে। কিন্তু যখন আমি ব্যালেন্স চাইব, রাষ্ট্র চাইব, তখন এখানে ব্যালেন্সটা দরকার বলেই আমরা মনে করি। বর্তমান সংস্কারের যে প্রস্তাব, এটাই সঠিক।
আমরা নির্বাচন পেছাতে কখনো বলিনি, পেছানোর পক্ষে না। ওই তারিখে (ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে) নির্বাচন আমরা করতে চাইছি। কিন্তু নির্বাচনের জন্য যে শর্তগুলোর কথা আমি বলেছি, সেগুলো তো সেটিসফাই (সন্তুষ্ট) করতে হবে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: যদি আপনার কথাই ধরি, আমাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, সে জন্য আমরা সংস্কার চাইছি। সংস্কারটা কি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতির? যদি রাষ্ট্রের জন্য, মানুষের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে আপনি সে বিবেচনা করতে পারেন। আর আমি ক্ষমতায় না গিয়েও যদি দেশের কল্যাণের জন্য সংস্কার চাই, এটাকে তো আপনার অ্যাপ্রিশিয়েট করা উচিত। নাম্বার টু, এখন আগেরটার জবাব দিই। বিএনপি ক্ষমতায় যাবে, যেতে পারে—এটা একধরনের মিথ আছে সব জায়গায়। কারণ, তারা সবকিছুকেই আগের অবস্থা থেকে বিবেচনা করছে। কিন্তু জুলাইয়ের পর যে একটা বিশাল পরিবর্তন হয়েছে মানুষের সাইকোলজিতে (মনোজগতে), এটাকে তারা কেউ কনসিডার (বিবেচনায়) করছে না।
আমি বলছি না, বিএনপি ক্ষমতায় যাবে না। কিন্তু আমি এটা বলি না যে বিএনপি যাবে। আমি এটাও বলছি না যে জামায়াত যাবে। এটাও বলছি না যে জামায়াত যাবে না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় যে বিএনপি ছিল, এটা বিশাল সংগঠন ছিল, জনপ্রিয় ছিল। এখন বিএনপি বিশাল সংগঠন, কিন্তু জনপ্রিয় নয়; এটা বাস্তবতা।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: জনমত জরিপের ভিত্তিতে। সর্বশেষ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি যে সার্ভে দিয়েছে, এখানে ১২ পার্সেন্ট বিএনপিকে দিয়েছে। টেন পয়েন্ট ফোর সেভেন পার্সেন্ট জামায়াতকে দিয়েছে। ডিফারেন্স কত? তার এক মাস আগে বা তারও আগে সানেম একটা সার্ভে করেছিল। সানেমের জরিপে ছিল বিএনপি ৪২ পার্সেন্ট, আমাদের ৩২ পার্সেন্ট। ডিফারেন্ট কত? দুইটা প্রতিষ্ঠানই জামায়াতকে পয়েন্ট বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিষ্ঠান নয়; পারলে দুই পয়েন্ট কম দেয়। সুতরাং সময়ের ব্যবধানে দেখা যায়, জামায়াত পার্থক্য কমাচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত হয়তো আরও কমতে পারে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: আমাদেরও সার্ভে আছে। আমাদের সার্ভে আমি এখন ফোকাস করব না। আরেকটি কথা বলি, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সাইকিক চেঞ্জের জন্য যে বয়ান তৈরি হচ্ছে। জরিপের ৪৮ পার্সেন্ট মতামত দেয়নি। এরা কারা? এরা নিশ্চয় বিএনপিও না, জামায়াতও না। তারা অপেক্ষায়, কাকে সমর্থন দেবে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: দক্ষিণপন্থী বলতে উনি কি বুঝিয়েছেন জানি না। আমরা তো মাঝেমধ্যে উত্তরেও যাই, আবার দক্ষিণেও সফর করি।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: দক্ষিণপন্থী উনি যেটা বলেছেন, এটা বাম রাজনীতি বা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যেটা বোঝায় যে কিছুটা নন ডেমোক্রেটিক, কিছুটা র্যাডিক্যাল। উনি যদি এটা বলে থাকেন, তাহলে উনি সঠিক বলেননি। কারণ, বাংলাদেশে এ রকম র্যাডিক্যাল পার্টি রাজনীতিতেও নেই, তাদের উত্থানও হচ্ছে না। বরং বাংলাদেশে দুর্নীতি, লুটপাট, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সৎ মানুষের অবস্থান জনমনে আগের চেয়ে অধিকতর অগ্রসর হয়েছে।
বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো দূরত্ব হয়নি। এখানে দূরত্বটা হচ্ছে নীতির, দল হিসেবে নয়। কারণ, বিএনপিকে পাইলে আমিও জড়িয়ে ধরি, আমারে পাইলেও বিএনপি জড়িয়ে ধরে। এই ভ্রাতৃত্ব তো আমাদের আছে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: না, আমরা নির্বাচন পেছাতে কখনো বলিনি, পেছানোর পক্ষে না। ওই তারিখে (ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে) নির্বাচন আমরা করতে চাইছি। কিন্তু নির্বাচনের জন্য যে শর্তগুলোর কথা আমি বলেছি, সেগুলো তো সেটিসফাই (সন্তুষ্ট) করতে হবে। এটা এ রকম নয় যে আপনি ডিসেম্বর হলে এসব দাবি পূরণ করবেন না, জুনে হলে করবেন। সরকার যদি এটা বলে, তাহলে আমরা জুনে চাই। আর সরকার যদি বলে, না আমি এ দাবি পূরণ করব, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করব, ইকুয়াল থাকব, তাহলে আমরা ডিসেম্বরও চাই। সুতরাং টাইমটাকে এনে বিএনপি বা সরকার মূল জায়গাটাকে গোপন করতে চাইছে, বিভ্রান্ত করতে চাইছে। এটাই এখন আমাদের রাজনীতি, এই বিভ্রান্তিটাকে দূর করা এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কাছে আসা।
দেখুন, ইউনুস সাহেব কী করেছেন? উনি বলেছেন যে আমি সংস্কার চাই, এখনো বলে। কিন্তু সংস্কার শেষ না হওয়ার আগেই উনি তারিখ ঘোষণা করে দিয়েছেন। এটাই তো নির্বাচনী ষড়যন্ত্র। ওনার উচিত ছিল, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে—এই ঘোষণাটা সংস্কার শেষ করে দেওয়া। যেমন সংস্কার যদি সেপ্টেম্বরে শেষ হয়, তাহলে নির্বাচনের ফেব্রুয়ারির তারিখটাই ঘোষণা দেওয়া উচিত অক্টোবরে। তাহলে আনক্লিন ব্যাম্বো নিয়ে আপনাকে আগাতে হতো না। এখন আমরা ভাবছি সংস্কার হবে কি হবে না। আর বিএনপি বলছে, সংস্কার দরকার নেই, আমি ইলেকশন ডেট পেয়ে গেছি। এখানে দুটো জায়গার একটা মৌলিক পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আমরা ডিফেন্সে চলে গেছি। আর এই বেনিফিটটা এই সরকার বিএনপিকে দিয়েছে।
বিএনপি বলেছে জোট হবে না। আমরা এ কথা ঘোষণা করিনি। কিন্তু আমরা একটা জোট করতেছি, যেখানে বিএনপি থাকবে না। সেখানে বিএনপির বাইরের মেজর রাইট, কিছুটা লেফট, ইসলামিস্ট—সবাই থাকবে। আমরা সেই চেষ্টা করছি ইনশা আল্লাহ।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো দূরত্ব হয়নি। এখানে দূরত্বটা হচ্ছে নীতির, দল হিসেবে নয়। কারণ, বিএনপিকে পাইলে আমিও জড়িয়ে ধরি, আমারে পাইলেও বিএনপি জড়িয়ে ধরে। এই ভ্রাতৃত্ব তো আমাদের আছে।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: বিএনপি বলেছে জোট হবে না। আমরা এ কথা ঘোষণা করিনি। কিন্তু আমরা একটা জোট করতেছি, যেখানে বিএনপি থাকবে না। সেখানে বিএনপির বাইরের মেজর রাইট, কিছুটা লেফট, ইসলামিস্ট—সবাই থাকবে। আমরা সেই চেষ্টা করছি ইনশা আল্লাহ।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: নির্বাচন ইস্যুটা আমরা এখনো সামনে আনছি না। অনেকগুলো জায়গার কথা আমরা বলেছি, সংস্কারের কথা আমরা বলেছি। সংস্কার এবং অন্যান্য ইস্যুতে আমাদের এখন লক্ষ্য কাছাকাছি। সে ক্ষেত্রে অন্তত এই জায়গা পর্যন্ত আমরা এখনো ঐক্যবদ্ধ আছি।
আবদুল্লাহ মো. তাহের: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
ক্রাইম বার্তা
