এসএম শহীদুল ইসলাম
সাতক্ষীরার শিক্ষাঙ্গনে ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার ছিল এক বিশেষ দিন। ক্যালেন্ডারের পাতায় এই তারিখ হয়তো অন্য বছরের মতোই চলে যাবে, কিন্তু সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শিক্ষা অঙ্গনে দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ, এদিনই শেষ কর্মদিবস ছিল সাতক্ষীরা সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নারায়ণ চন্দ্র মন্ডলের।
মাত্র দেড় বছর আগে তিনি সদর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষার হাল ধরে ছিলেন। অল্প সময়Ñ কিন্তু সেই সময়ের ভেতর যে আলো তিনি ছড়িয়ে গেলেন, তা যেন দিগন্ত ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ছিলেন সৎ, দায়িত্বশীল, দূরদর্শী ও আলোকবর্তিকা-সদৃশ এক শিক্ষাবন্ধু। শিক্ষার মাঠে তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন কৃষকের মাঠে মেঘের ছায়াÑ শীতলতা ও আশার বাণী নিয়ে আসে।
দেড় বছরে তিনি যে পরিশ্রম, আন্তরিকতা ও মমতা ঢেলে দিয়েছিলেন, তা যুগ থেকে যুগান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে দ্যুতি ছড়াবে। তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, সেই দৃঢ়তার আড়ালে লুকিয়ে থাকত অসীম মমতার সুর। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক—সবাইকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক মানবিক ও প্রগতিশীল শিক্ষার পরিবেশ।
বৃহস্পতিবার এই বিদায় বেলায় আবেগ ছড়িয়ে পড়েছিল শরতের নির্মল বাতাসের মতো। ধুলিহর-ব্রহ্মরাজপুর (ডিবি) মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. এমাদুল ইসলাম এবং সহকারী শিক্ষক এসএম শহীদুল ইসলাম বিদায়ী শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান এই আলোকিত মানুষটিকে। কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা, হৃদয়ে ভালোবাসা। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবুল হোসেন। তার চোখেমুখেও ছিল একইসঙ্গে গর্ব ও শূন্যতার ছাপÑগর্ব এই মানুষটিকে সহকর্মী হিসেবে পাওয়ার, আর শূন্যতা তার বিদায় বেলায়।
প্রকৃতি যেন আজকের দিনটিকে বিশেষভাবে সাজাতে চেয়েছিল। ভোরের কুয়াশায় ঝরে পড়া শিশির, দুপুরের রোদ্দুরের সোনালি ঝিলিক, আর সন্ধ্যার মৃদুমন্দ হাওয়ার স্পর্শÑ সবকিছুতেই ছিল বিদায়ের আবেগ, তবু সঙ্গে ছিল নতুন সূচনার প্রত্যাশা।
জনাব নারায়ণ চন্দ্র মন্ডল শুধু একজন শিক্ষা অফিসার নন, তিনি ছিলেন এক প্রেরণা, এক দিকনির্দেশক, যিনি পথ দেখিয়েছেন শিক্ষকদের, সাহস যুগিয়েছেন শিক্ষার্থীদের, আর আশার আলো জ্বালিয়েছেন সমাজের বুকে। তার বিদায় হয়তো প্রশাসনিক নিয়মের অংশ, কিন্তু তার রেখে যাওয়া স্মৃতি, তার কর্মের দীপ্তি এবং তার ব্যক্তিত্বের ঋজুতা চিরকাল জাগ্রত থাকবে সাতক্ষীরার শিক্ষাঙ্গনে।
তার প্রতি এই শ্রদ্ধাঞ্জলি কেবল শব্দে সীমাবদ্ধ নয়Ñ এটি এক অঙ্গীকার, তার দেখানো আলোর পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার।
একত্রিশ বছরের কর্মজীবন বৃহস্পতিবার থেমে দাঁড়াল ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য রকম আবহে। পলাশপোল আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে শিশুরা ছুটে এলো, মধুর কোলাহলে ভরে দিল বিদায়ের গম্ভীর মুহূর্ত। তাদের উজ্জ্বল চোখে ছিল অদৃশ্য অশ্রুবিন্দু, ঠোঁটে ছিল মিষ্টি হাসিÑ যেন এক নীরব কবিতা, বিদায়ের বুক চিরে আলো দেখানো ভবিষ্যতের গান।
এরপর এলেন শিক্ষকবৃন্দ। বাহ্যিক চাকচিক্যের আয়োজন ছিল না, তবুও অন্তরের নিরাভরণ ভালোবাসা ঢেকে দিল চারপাশ। করমর্দনে, শুভকামনায়, আন্তরিক দৃষ্টিতে যেন ঝরে পড়ল শরতের আকাশভরা নীল, কাশফুলের সাদা মায়া। তিনি নিজেও সিক্ত হলেন সেই ভালোবাসায়, যেন হৃদয়ের বুকে লিখে রাখলেন অমলিন অক্ষরেÑ “কৃতজ্ঞ আমি, কৃতজ্ঞ চিরকাল।”
অফিস কক্ষে প্রবেশ করতেই সহকর্মীরা দাঁড়িয়ে। চেনা মুখগুলো আজ অচেনা আবেশে ভরে উঠল। টেবিল, চেয়ার, দেয়ালÑ সবকিছু যেন ফিসফিস করে বলল তার কর্মের কথা। সহকর্মীরা বিদায় জানালেন, কিন্তু তাদের চোখের কোণায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জলই বলল প্রকৃত ভাষা।
শেষ বিকেলে অফিসার্স ক্লাবের আমন্ত্রণ। বিদায়ের আরেকটি অধ্যায়, আরেকটি আবেগের সমুদ্র। তিনি শুধু বললেনÑ “দীর্ঘ কর্মজীবনে সহকর্মী, স্টাফ আর অসংখ্য শিক্ষকম-লীর অকৃপণ সহায়তা পেয়েছি। আমি ঋণী। আজ বিদায়ের বেলায় ক্ষমা চাইছি সবার কাছে। দোয়া করবেন আমার জন্য।”
এই বিনম্র কণ্ঠে ছিল সমগ্র জীবনের সারাংশ। বিদায় আজ, তবুও বিদায় নয়। এ বিদায় নতুন এক যাত্রার আহ্বান। এ বিদায় কেবল চাকরির ইতি নয়, এটি অগণিত স্মৃতির সূচনা।
শরতের আকাশে ভেসে থাকা সাদা মেঘের মতো তার কর্মজীবন রেখে গেল স্বচ্ছতা, আন্তরিকতা আর ভালোবাসার চিহ্ন। সময় হয়তো থেমে গেল তার দায়িত্বের দরজায়, কিন্তু তার শ্রম, তার সততা, তার প্রজ্ঞাÑ এসব অনন্তকাল ছড়িয়ে যাবে সাতক্ষীরার শিক্ষাঙ্গনে।
বিদায় বন্ধু, বিদায় প্রেরণার আলো। আপনার রেখে যাওয়া দীপশিখা জ্বালিয়ে রাখবে আগামী প্রজন্মের হৃদয়, কাল থেকে কালান্তরে। লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদকর্মী
ক্রাইম বার্তা