গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি গঠনে তোড়জোড়

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক নির্দেশনা জারির পর সাতক্ষীরায় শুরু হয়েছে নতুন করে কমিটি গঠনের ব্যাপক তোড়জোড়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা ব্যস্ত সময় পার করছেন নির্বাচনী প্রস্তুতিতে।

সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব সাইয়েদ এ. জেড. মোরশেদ আলী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কমিটি গঠন করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে এডহক কমিটি এখনো গঠন হয়নি, সেসব প্রতিষ্ঠানে ১৫দিনের মধ্যে এডহক কমিটি গঠন করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, সব এডহক কমিটি ১ ডিসেম্বর থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হবে।

কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়ী থাকবেন এবং বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে নতুন প্রবিধান অনুযায়ী, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে হলে অন্তত স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। কেউ একই প্রতিষ্ঠানে দুই মেয়াদের বেশি সভাপতি হতে পারবেন না এবং এক ব্যক্তি তিনটির বেশি প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে সভাপতি বা সদস্য পদে থাকতে পারবেন না।

এই নির্দেশনার প্রেক্ষিতে সাতক্ষীরার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগের জন্য জমা পড়ছে আবেদনপত্র। প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে মনোনয়ন পাচ্ছেন সাধারণত উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা, উপজেলা সমাজসেবা কর্তকর্তা, উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা, শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপাভাইজারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা।

নিজেদের দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি এসমস্ত কর্মকর্তাগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠন উপলক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পাদনের জন্য কাজ করছেন বলে জানান। প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে মনোনয়নপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা শুরু করেছেন। এতে করে জেলাজুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরাজ করছে নির্বাচনী আমেজ। কয়েকজন প্রিজাইডিং অফিসারের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে তারা নিজেদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন।

জেলার প্রায় সর্বত্র এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠনের আলোচনা শুরু হয়েছে। অভিভাবকরাও শামিল হচ্ছেন ভোটের আলোচনায়। অবিভাবক সদস্য পদে নির্বাচনে অংশ নিতে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছেন অনেকেই।
এদিকে স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে ঘোষণা করা হচ্ছে নির্বাচনী তফসিল। পাশাপাশি, প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী যোগ্য প্রার্থীর খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছেন অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান। অন্তত অর্ধডজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, নির্ধারিত যোগ্যতার মানদ-ে উপযুক্ত ব্যক্তি পাওয়া অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সভাপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও শর্তারোপ করায় অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান পড়েছেন টেনশনে। গ্রাম্য এলাকায় মিলছে না বিধি মোতাবেক যোগ্য প্রার্থী।

অন্যদিকে ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও যাচাইয়ের কাজ শেষ করেছে জেলার বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে সাতক্ষীরার শিক্ষাঙ্গনে এখন ম্যানেজিং কমিটি গঠনের ব্যস্ত সময় চলছে।

জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা জেলায় সরকারি তালিকাভুক্ত ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৫৮৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত ও নন-এমপিও উভয় শ্রেণির মাদ্রাসা এবং মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত।

জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার সংখ্যা ১৬২টি। এর মধ্যে দাখিল ১১৫টি, আলিম ২২টি, ফাজিল ২২টি এবং কামিল ৩টি। অন্যদিকে নন-এমপিও মাদ্রাসার সংখ্যা ৫২টি, যার মধ্যে দাখিল ৫১টি ও আলিম ১টি। এমপিওভুক্ত অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ৫৯টি, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২৯৩টি এবং নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২২টি রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি কলেজ ৫৮টি।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোনা ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হাসানুর রহমান বলেন, ৩০নভেম্বরের মধ্যে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন সম্পন্ন করতে সরকারিভাবে নির্দেশনা রয়েছে। আবার আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছে সরকার। সেকারণে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে দুটি বড় দলের নেতা-কর্মীরা ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। তবে নিরপেক্ষতার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করছি।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. মোমিনুল ইসলাম শামীম বলেন, ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন একেবারে যে প্রভাবমুক্ত হবে— তা বলা যাবে না। কেননা এ্যাডহক কমিটি গঠনের সময় আমরা দেখেছি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলাদলির ঘটনা ঘটেছিল। তিনি আরও বলেন— যদিও এবার ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে অভিভাবক সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে সভাপতি নির্বাচন হবে না, সেকারণে দলদলি হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। তবে কোথাও কোথাও অভিভাবক সদস্য পদে নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন।

সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক গাজী বলেন— আগে মূলত সভাপতি নির্বাচন হতো নির্বাচিত অভিভাবক সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে। তখন সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার আশায় একাধিক প্যানেলে অভিভাবকরা জড়িয়ে পড়তেন। এবার সেই সুযোগ নেই। এবার নির্বাচিত অভিভাবক সদস্যদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সভাপতি নির্বাচিত হবেন না। তাই সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের প্রভাব খুব বেশি পড়বে বলে মনে হয় না। তবে অভিভাবক সদস্য পদে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। সেক্ষেত্রে এলাকা ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রভাব পড়তে পারে।

সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি কৃষ্ণানন্দ মুখার্জি বলেনÑযেহেতু ইতোমধ্যে সাতক্ষীরাসহ গোটা দেশে ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচনের ডামাডোল বেঁজে উঠেছে। আবার জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে। সেজন্য ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অংশগ্রহণ থাকবে এটা স্বাভাবিক। সভাপতি নির্বাচনে অভিভাবক সদস্যদের ভোটাধিকার না থাকলেও যারা অভিভাবক সদস্য হবেন কিংবা শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তারাও কোন না কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী, সমর্থক বা নেতা হতে পারেন। সুতরাং ম্যানেজিং নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের অংশ থাকবেÑএটা স্বাভাবিক।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মুফতি আবুল খায়ের জানানÑসরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কমিটি গঠন করতে হবে। যেকারণে ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিরাজ করছে নির্বাচনী আমেজ। অভিভাবক সদস্য নির্বাচন, সংরক্ষিত নারী অভিভাবক সদস্য নির্বাচন এবং শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্পূর্ণ অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একটি শিক্ষাবান্ধব কমিটি উপহার দেওয়ার জন্য প্রিজাইডিং অফিসারগণ কাজ করে যাচ্ছেন।

 

About news-admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *