ড. মো. মনিরুজ্জামান এবং মো. মমিনুর রহমান
সাতক্ষীরা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এই জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এবং অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ও গুরুত্বপূর্ন স্থলবন্দর ভোমরা এই জেলার প্রাণ। দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ ও বাণিজ্যে সাতক্ষীরার অবদান অনেক। চিংড়ি, মাছ, আম, মধু ও পর্যটন—সব ক্ষেত্রেই সাতক্ষীরা দেশের গর্ব। তবুও এই জেলার উন্নয়ন আজও পিছিয়ে আছে। প্রয়োজনীয় সরকারি বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের সুযোগ—সব ক্ষেত্রেই সাতক্ষীরা জেলা বঞ্চিত।
প্রাচুর্যের জেলা
সাতক্ষীরা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। সুন্দরবনের কাছাকাছি হওয়ায় এই জেলা পরিবেশগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ত পানির ক্ষতি থেকে মানুষকে রক্ষা করে এবং কাঠ, মধু, মাছ ধরার পাশাপাশি ইকো-ট্যুরিজমের সুযোগ এনে দেয়।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও সাতক্ষীরা শক্তিশালী। ভোমরা স্থলবন্দর বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থল বন্দর, যা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে বড় ভূমিকা রাখে এবং সরকারের জন্য বিপুল রাজস্ব আনে। সাতক্ষীরা দেশের চিংড়ি উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র, যাকে বলা হয় দেশের “সাদা সোনা”। হাজার হাজার মানুষ এই খাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। মিষ্টি পানির মাছ, লবণাক্ত সহনশীল মাছ এবং চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর বিপুল অর্থ আয় হয়।
সাতক্ষীরার আমও বিখ্যাত। সুস্বাদু এই আম এখন ইউরোপের বাজারে পৌঁছেছে, এমনকি লন্ডনের দোকানেও বিক্রি হয়। সুন্দরবনের কাছাকাছি অবস্থান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য মিলে সাতক্ষীরা ইকো-ট্যুরিজমের জন্য দারুণ সম্ভাবনাময় একটি জায়গা। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এটি টেকসই পর্যটনের কেন্দ্র হতে পারে।
উন্নয়ন বঞ্চিত সাতক্ষীরা
এই সব সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে বঞ্চনা আর অবহেলার গল্প। খুলনা বিভাগের জেলাগুলির মধ্যে সাতক্ষীরা এখনো সবচেয়ে পিছিয়ে। জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ রাস্তা এখনো কাঁচা। বর্ষাকালে এই রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে যায়, ফলে অনেক গ্রাম শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এখনো কোনো রেললাইন না থাকায় মানুষ ও পণ্যের যাতায়াত ব্যাহত হয়।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সাতক্ষীরা পিছিয়ে। এখানে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীদের খুলনা বা ঢাকায় যেতে হয়। অনেকেই আর ফিরে আসে না, ফলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষিত তরুণদের ঘাটতি বাড়ে। যদিও “সাতক্ষীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়” নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে, কিন্তু এখনো কার্যক্রম শুরু হয়নি।
প্রশাসনিক দিক থেকেও সমস্যা আছে। সাতক্ষীরার অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় মানুষ প্রায়ই ভুলভাবে উপস্থাপিত হন। তাদের বদলি, পদোন্নতি ও উন্নয়নের সুযোগ কমে যায়। এতে হতাশা ও অনুপ্রেরণার অভাব তৈরি হয়। ভুল ধারণা ও নেতিবাচক প্রচারণার কারণে সাতক্ষীরার মানুষ কর্মসংস্থান, উন্নয়ন প্রকল্প ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত।
ঘূর্ণিঝড় আইলা, আম্ফান ও সিডর সাতক্ষীরায় ভয়াবহ ক্ষতি করেছে। অনেক মানুষ ঘরবাড়ি, জমি ও জীবিকা হারিয়ে দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে গেছে। দুর্যোগের পর সরকারি সহায়তা প্রায়ই দেরিতে আসে বা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। দুর্বল বাঁধ ও লবণাক্ত পানি কৃষিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, পানীয় জলের অভাব বাড়ছে। স্বাস্থ্যসেবা খুবই দুর্বল—প্রয়োজনে চিকিৎসা পাওয়া কঠিন। রাস্তা খারাপ থাকায় ত্রাণ পৌঁছাতেও দেরি হয়। এসব কারণে সাতক্ষীরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে সঠিক মনোযোগ না পাওয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসনসহ মৌলিক খাতগুলো দুর্বল। ফলস্বরূপ, দেশকে এত কিছু দেওয়ার পরও সাতক্ষীরার মানুষ সবচেয়ে বেশি বঞ্চিতদের মধ্যে রয়ে গেছে।
অবহেলার কারণ
সাতক্ষীরার বঞ্চনা বাংলাদেশের কেন্দ্রীভূত উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রতিফলন। ঢাকাকেন্দ্রিক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দূরের জেলা হিসেবে সাতক্ষীরা বারবার উপেক্ষিত। বন্দর, মাছ, আম, চিংড়িÑসবকিছু থেকে দেশ আয় করে, কিন্তু সেই অর্থের অল্প অংশই সাতক্ষীরার উন্নয়নে ব্যবহার হয়।
রাজনৈতিক গেইম-এর কারণেও সাতক্ষীরা পিছিয়ে আছে। এখানকার দরিদ্র মানুষ আরও দরিদ্র হচ্ছে, আর ধনী লোকেরা আরও ধনী হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সাতক্ষীরার মানুষ মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও ন্যায়ের দাবিতে সাহসিকতা দেখিয়েছে। কিন্তু তারপরও এখনো জেলার উন্নয়ন নিয়ে খুব কম আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বরং অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেতিবাচক খবর ছড়ানো হয়। এটি শুধু সাতক্ষীরার ক্ষতি নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। একটি জেলা অনুন্নত থাকলে, পুরো দেশের উন্নয়ন অসম্ভবÑএই সত্যটা সবাইকে বুঝতে হবে।
উন্নয়নের পথ
সাতক্ষীরার উন্নয়নের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। জেলা হিসেবে এটি অবহেলার নয়, বরং দেশের উন্নয়ন ও জলবায়ু সহনশীলতার অন্যতম চালিকাশক্তি হতে পারে।
১. বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প:
“সাতক্ষীরা উন্নয়ন ও জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা প্রকল্প” নামে একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত। এতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে এবং গুরুত্ব দিতে হবে অবকাঠামো, শিক্ষা ও টেকসই জীবিকার ওপর।
২. উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা:
সব প্রধান রাস্তা পাকা করা এবং খুলনা-যশোরের সঙ্গে রেললাইন সংযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন। এতে ব্যবসা, পর্যটন ও মানুষের চলাচল সহজ হবে।
৩. বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন:
অনুমোদিত সাতক্ষীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম দ্রুত শুরু করা দরকার। এতে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা নিজ জেলায় থেকে পড়াশোনা ও গবেষণা করতে পারবে।
৪. দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন:
ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সহায়তা শুধু ত্রাণে সীমিত না থেকে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন, বাঁধ মেরামত ও মিষ্টি জলের সঠিক ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে।
৫. ন্যায্য প্রশাসন:
স্থানীয় জনগণ ও কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও বেশি ভূমিকা দিতে হবে। অন্যায্য আচরণ, বিলম্বিত পদোন্নতি বা ভুল ধারণা বন্ধ করতে হবে।
৬. বিনিয়োগ ও পর্যটন:
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে ইকো-ট্যুরিজম, আধুনিক চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ ও আম রপ্তানির নতুন সুযোগ তৈরি করতে হবে। এতে কর্মসংস্থান ও স্থানীয় ব্যবসা বাড়বে।
৭. সাতক্ষীরা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা:
কৃষি ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর হওয়া দুঃখের বিষয়, এই সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর জন্য এখনও কোনও পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠেনি। সাতক্ষীরায় একটি আধুনিক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে শুধু সাতক্ষীরার অর্থনীতি নয়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে।
ন্যায্যতার আহ্বান
সাতক্ষীরা সুন্দরবনের অক্সিজেন দেয়, রপ্তানির অর্থ দেয়, দেশকে সমৃদ্ধ করে। তবুও, এখানকার মানুষ এখনো নীতি, সুযোগ ও মর্যাদার দিক থেকে পিছিয়ে। একটি দেশের উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন সব অঞ্চল সমানভাবে এগিয়ে যায়।
সাতক্ষীরার উন্নয়ন কোনো দয়া নয়—এটি ন্যায্যতার দাবি। এই জেলা অর্থনীতি ও পরিবেশ উভয়কে রক্ষা করে, তাই এর প্রাপ্য সুযোগ পাওয়া উচিত। সঠিক পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে, সাতক্ষীরা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য টেকসই উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।-
মো. মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইজিএম), এবং প্রাক্তন অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ সরকার।
মো. মমিনুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, এবং বিআইজিএম জার্নাল অফ পলিসি অ্যানালাইসিসের সহযোগী সম্পাদক
ক্রাইম বার্তা