আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্তঘেঁষা জেলা সাতক্ষীরা। ভৌগোলিক কারণে এ জেলার গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় আসন সাতক্ষীরা-২ (সাতক্ষীরা সদর+দেবহাটা)। ৫৭১.৭৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এলাকায় ৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৯০ ভোটারের আসনটি স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকে রয়ে গেছে অবহেলিত। আসনটি জামায়াতে ইসলামীর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার পর থেকে ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের পৃথক অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য ১২ জুন ১৯৯৬-এর নির্বাচন ও ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-২ আসনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, জামায়াতের শেখ কাজী শামসুর রহমান পান ৩৫.২৫ শতাংশ ভোট। আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও এএফএম ইন্তাজ আলীপান ২৬.৪৫ শতাংশ ভোট। জাতীয় পার্টির সৈয়দা রাজিয়া ফায়েজ ও মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান পান ২৫.৬৫ শতাংশ ভোট এবং বিএনপির এম. মনসুর আলী ও ফরিদা রহমান পান ১১.৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ সাতক্ষীরা-২ আনসে জামায়াত প্রথম, আ’লীগ দ্বিতীয়, জাতীয় পার্টি তৃতীয় ও বিএনপির অবস্থান চতুর্থ।
স্থানীয় ভোটার ও রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিরপেক্ষ নির্বাচনে বরাবরই এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী বিজয়ী হওয়ায় এবারও তাদের অবস্থান অনেক মজবুত। তাছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলের একাধিক প্রার্থী এবং জামায়াতের একক প্রার্থী দলটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও সাবেক জেলা আমীর মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল খালেক শক্ত অবস্থানে আছেন। জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সৈয়দ ইফতেখার আলী, টানা সাতবারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আব্দুল আলীম, জেলা বিএনপির সহসভাপতি পদ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত ও বার বার নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ, সাতক্ষীরার পৌরসভার বার বার নির্বাচিত পৌর মেয়র তাসকিন আহম্মেদ চিশতিসহ ডজনখানেক বিএনপি নেতা মনোনয়ন পেতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গত ৩ নভেম্বর সোমবার দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব এ আসনে আব্দুর রউফকে ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে। তবে প্রয়োজনে তা পরিবর্তনও করতে পারে বলে জানিয়েছে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রার্থী যিনিই হোক, এ আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে জামায়াত-বিএনপির মধ্যে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এ জেলায় জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী এবং সাধারণ জনগণের ওপর ব্যাপক জুলুম, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। স্বৈরাচার হাসিনা ও তার পেটোয়া বাহিনীর অত্যাচারে এ জেলায় জামায়াত-বিএনপির কমপক্ষে শতাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। এসব কারণে আগস্ট বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক মাঠ ছেড়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। অনেকে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন।
একনজরে সাতক্ষীরা-২ আসন : ১৯৭০ থেকে ৭ জানুয়ারি ২০২৪
সাতক্ষীরা-২ (সদর) নির্বাচনী এলাকায় স্বাধীনতা পরবর্তী ১২টি নির্বাচনে জামায়াত মনোনীত দাঁড়িপাল্লার প্রার্থীরা ৪ বার, আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা ৩ বার জয়লাভ করেন। এছাড়া বিএনপি একবার, জাতীয় পার্টি ৩ বার এবং মুসলিম লীগ প্রার্থী একটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি কলঙ্কজনক দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ডামি নির্বাচনে এই আসনে জাতীয় পার্টি (জাপা) মনোনীত মহাজোটের প্রার্থী আশরাফুজ্জামান আশু লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ৮৮ হাজার ৩৫৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, আ’লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তৎকালীন সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ঈগল প্রতীক নিয়ে পান ২৭ হাজার ৪৪৭ ভোট।
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল খালেক বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হলে অবহেলিত সদর আসনের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা নিরসন, মুন্সীগঞ্জ থেকে নাভারন রেললাইন স্থাপন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি বন্ধসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা হবে।’
বিএনপির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক, লাবসা ইউনিয়নের সাতবারের নির্বাচিত নিয়মিত চেয়ারম্যান মো. আব্দুল আলীম বলেন, ‘দীর্ঘদিন স্বৈরাচার ক্ষমতায় থাকায় এ জেলায় কোনো উন্নয়ন হয়নি। জনগণের রায়ে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে এ জেলায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি নেওয়া হবে। জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং দুর্নীতি বন্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক তৎপরতা চালানো হবে।’
জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা এবং মানুষের আস্থার জায়গা থেকে সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, সাতক্ষীরা জেলা ট্রাক মিনিট্রাক ট্যাংকলরি কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি, সাতক্ষীরা জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং আলীপুর ইউনিয়ন পরিষদের বার বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুর রউফকে মনোনয়ন দিলে সাতক্ষীরা সদর ও দেবহাটা উপজেলা মিলে গঠিত সাতক্ষীরা-২ আসনে বিএনপি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে বলে দাবি করেছেন সাধারণ মানুষ ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
সাতক্ষীরা-২ আসনে জামায়াত প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, সাতক্ষীরা জেলা শহর, পৌরসভা, সদরের ১৪টি ইউনিয়ন ও দেবহাটার ৫টি ইউনিয়নসহ মোট ১টি পৌরসভা ও ১৯টি ইউনিয়ন গঠিত এ আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সদর উপজেলা জেলা প্রশাসনের মূল কেন্দ্র। এখানকার সমস্যাগুলো শহরমুখী-যানজট, নগর পরিকল্পনা, পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার আধুনিকীকরণ। অন্যদিকে দেবহাটা গ্রামীণ-সীমান্তঘেঁষা এখানকার মূল সমস্যা নদীভাঙন, লবণাক্ততা, চাষাবাদ, সীমান্ত বাণিজ্য ও অবকাঠামোগত ঘাটতি। একই এমপির অধীনে এই দুই বিপরীত প্রাকৃতিক সমস্যা সমাধান ও যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় শহর ও গ্রামের মধ্যে সমন্বয় সাধনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী জননেতা মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।
ক্রাইম বার্তা