সাতক্ষীরার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী জেলা ছাত্রলীগের সদ্য বিহষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক সাদিকের উত্থান-পতন

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোটঃ টোকাইদের সরদার ছিল সে। বয়স বাড়তেই হয়ে ওঠে কিশোর গ্যাংয়ের লীডার। এই লীডারের নেতৃত্বে ২০১৬ সালে সাতক্ষীরা শহর ও এর আশপাশে অনেকগুলি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। পুলিশ চিহ্নিত ডাকাতদের ধরতে থাকে। আড়ালে গ্যাং লিডার সাদিকুর ও তার কিশোর বাহিনী মজা দেখতে থাকে। এই গ্যাংয়ের একজন শহরের মুন্সিপাড়ার সোহাগ খুন হয়। এই খুনের নেপথ্যেও ছিল তার বস গ্যাং লিডার সৈয়দ সাদিকুর রহমান। মামলা হলেও তা থেকে বাদ পড়ে যায় সাদিকুর।
এভাবেই হাতে খড়ি হয় সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুরের সৈয়দ মোকলেছুর রহমানের ছেলে সৈয়দ সাদিকুর রহমানের। ছাত্রলীগের সাধারণ কোনো কর্মী ছিল না সে। এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের কোনো নেতাও নয়। সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে এসএসসি পাস করে ভর্তি হয় সিটি কলেজে। ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করার পরে ঢাকার ফার্মগেটের একটি প্রতিষ্ঠানে হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তি হয়ে কোর্স শেষ না করেই সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হলেও সাদিকুর উত্তীর্ণ হয়নি বলে জানা গেছে। এর মধ্যে কবে সে ছাত্রলীগের কর্মী কিংবা নেতা হলো তা অজানা। কোন যাদু বলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিয়েছিল তা নিয়ে প্রচার রয়েছে যে ৪০ লাখ টাকায় কমিটি কিনে নেওয়া হয়। এরপর থেকেই সোনায় সোহাগার মতো ধাই ধাই করে উত্থান হতে থাকে সৈয়দ সাদিকুরের। তার সাঙ্গপাঙ্গ জুটে যায় অনেক। চাঁদাবাজির জাল বিছাতে থাকে সাদিকুর ও তার বাহিনী। কখনও প্রাইভেট কারে, কখনও হোন্ডায়। রাত কিংবা দিন। অন্ততঃ ১২ জন দেহরক্ষী নিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে সাদিকুর।
সৈয়দ সাদিকুর রহমানের দেহরক্ষী হিসাবে বহুল আলোচিত কালিগঞ্জের সাঁইহাটি গ্রামের আবদুস সবুর সরদারের ছেলে সাইফুল ইসলাম ও শহরের মুনজিতপুরের ময়নুল ইসলামের ছেলে মামুনুল ইসলাম দ্বীপ, দুই যুবকের বিরুদ্ধে গত ৩১ অক্টোবর কালিগঞ্জের পাওখালিতে বিকাশ এজেন্টকে গুলি করে মোটর সাইকেল থামিয়ে ২৬ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। পুলিশ এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তাদের গ্রেফতার করে। তাদের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে গ্যাং লিডার সৈয়দ সাদিকুরের নাম। সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে এক প্রেসব্রিফিংয়ে বলেন ‘সৈয়দ সাদিকুর ছিল এই ছিনতাইকান্ডের মাস্টারমাইন্ড। সে ছিনতাইকৃত টাকার সিংহভাগ নিয়ে সাতক্ষীরা ছেড়েছে। কিছু টাকা তার সহযোগী ক্যাডারদের মাঝে ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে গেছে বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে’।
পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, ২৯ নভেম্বর রাতে মামুনুল ইসলাম দ্বীপ ও সাইফুলকে নিয়ে পুলিশ শহরের কামাননগরে বাইপাস সড়কের ধারে গোপন ডেরায় অন্য সহযোগীদের গ্রেফতার করতে নিয়ে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। জবাবে পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এসময় দুইপক্ষের গোলাগুলির মধ্যে নিহত হয় দ্বীপ ও সাইফুল। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দুটি দেশি পিস্তল ও চার রাউন্ড গুলি জব্দ করে।
গডফাদার সৈয়দ সাদিকুর রহমান তার অন্যান্য সব দেহরক্ষীর হাতে বেআইনি অস্ত্র তুলে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা এই শহর ও শহরের অদুরে বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। মাত্র ক’দিন আগেও ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে শহরে নিয়ে আসা একটি স্বর্ণের চালান অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাদিকুর বাহিনী চোরাচালানিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। গত ২৮ মে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে সাংবাদিকদের রক্তাক্ত জখম করে দম্ভের সাথে চলে যায়। এই হামলাকারীদের মধ্যে ছিল সাদিকুরের বডিগার্ড দ্বীপ ও সাইফুলসহ কয়েকজন। সাদিকুর এ সময় সড়কে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। জেলাব্যাপী সকল টেন্ডারের ভাগ বসিয়ে আসছিল সাদিকুর বাহিনী। জোরপূর্বক টেন্ডারবাক্স ছিনতাই অথবা সমঝোতার মাধ্যমে ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে বহুদিনের। দুই বছর আগে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর জেলা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি পদ লাভের পর সাদিকুর সকল স্থানে তার পরিচয় জানিয়ে তাকে নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার কথা বলে দেন। শহর ও শহরতলীর বহুজনের জমি দখলেও ওস্তাদের ভূমিকা পালন করে সাদিকুর ও তার বাহিনী। সম্প্রতি শহরের বাইপাস সড়কের ধারে পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক রাশেদুজ্জামান রাশির পৈতৃক জমি দখল করতে গিয়েছিল সাদিকুর বাহিনী। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় বাধা পেয়ে ফিরে আসে সেখান থেকে। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও ছাত্রবাস থেকেও নিয়মিত চাঁদা আদায় করে সাদিক বাহিনীর দুই ক্যাডার জামাল ও কালাম।
গত ৩ আগস্ট রাতে শহরতলীর মাছখোলায় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির প্রয়াত সভাপতি আইউব আলির নিঃসন্তান বিধবা স্ত্রী হোসনে আরার বাড়ির জমি চুক্তিভিত্তিক দখলের জন্য রাত ১১টার দিকে সাদিকুর বাহিনী ছাত্রলীগের কয়েক ক্যাডারকে নিয়ে সেখানে হামলা করে। এদের মধ্যে দ্বীপ ও সাইফুলও ছিল। সেখানকার মেস বাড়িতে থাকা ছাত্রদের পাল্টা হামলায় সাদিকুর ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়। তবে গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে রাতেই তারা পালিয়ে আসে। সাদিকুর সে সময় দাবি করেছিল ‘আমরা সাতক্ষীরা সদর থানার পুলিশকে জানিয়ে এই অভিযানে গিয়েছিলাম’।
প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাহিনীর ক্যাডারদের নিয়ে সাদিকুরের মজমা বসত শহরের কামানগরের প্রাণিসম্পদ অফিসের আশপাশে। সেখানে বসে মদ-ইয়াবা-ফেনসিডিলের আসর। বছর খানেক আগে সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ মৎস্য ব্যবসায়ী আনারুল ইসলামকে ফোনে ডেকে পাঠায় সাদিকুর। প্রাণিসম্পদ অফিসের কাছে নিয়ে সাদিকুর তার কাছে দাবি করে মোটা অংকের চাঁদা। আওয়ামী লীগের পৌর কমিটিকে অবহিত করে তিনি আনারুল বিষয়ে সাতক্ষীরা থানায় একটি মামলা করেন। এমনকি এ নিয়ে তিনি একটি প্রেস কনফারেন্সও করেন। কিন্তু সে মামলা ভস্মীভূত হয়ে যায় সাদিকুরের রাজনৈতিক গুরুর দাপটে। সাদিক বাহিনীর সদস্য দেহরক্ষী মামুনুল ইসলাম দ্বীপ ২০১৮ এর সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে একটি স্কুলের নৈশ প্রহরী মুন্সিপাড়ার সোহাগকে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। দ্বীপ সাদিকুরের লোক এবং সোহাগও সাদিকুরের অনুসারী হওয়ায় এই হত্যার ঘটনাটি বেশীদূর গড়াতে পারেনি। সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলে তা চাপা পড়ে যায়।
এক বছর মেয়াদি কমিটির দুই বছর পার হলেও পূর্নাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়নি। এক্ষেত্রে তাদের গাফিলতির অভিযোগ করেন সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী। ছাত্রলীগের উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে জানা গেছে সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাতটি উপজেলা ও একটি পৌর কমিটি বারবার ভাঙাগড়া করেছেন। টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠন করে দেওয়ার পর ২/৩ মাস যেতেই ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে ফের নতুন কমিটি গঠন করেন তিনি। এজন্য নয়া কমিটির কাছ থেকে নতুন করে নগদ চাঁদা, মাছ, হরিণের মাংসসহ নানা উপঢৌকন আদায় করেন তিনি। এসব বিষয়ে ছাত্রলীগের নেতারা সাংবাদিকদের কাছে এমনকি কেন্দ্রেও বারবার অভিযোগ করেছেন। কোনা লাভ হয়নি। কমিটি ভাঙাগড়ার কাজে সাদিকুর ব্যবহার করেন হাতে লেখা একটি প্রেস রিলিজ। ছাত্রলীগের পদ পাওয়ার আগে থেকেই সৈয়দ সাদিকুর রহমান একজন বিবাহিত যুবক। স্ত্রীর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
২০১৮ সালের ২৬ মার্চ শহরের শহিদ স ম আলাউদ্দিন চত্বরে মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যুবলীগের মনোয়ার হোসেন অনুকে ছুরিকাঘাত করে আহত করে সাদিকুরের দেহরক্ষী দ্বীপ। সাদিকুর মুনজিতপুরের জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ হায়দার আলী তোতার ভাতিজা। গত ২৫ সেপ্টেম্বর তোতার বাড়ি থেকে একদল জুয়াড়ি ও জুয়ার সরঞ্জাম আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে সাদিকুরের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি মামলা হয়েছে। এই মামলার দুই আসামি তার দেহরক্ষী আজিজুল ও সামি হাসান সোহানকে অস্ত্রসহ আটক করে পুলিশ জেল হাজতে পাঠিয়েছে।
নিহত দেহরক্ষী সাইফুল সুলতানপুরে জনৈক আবুবকরের আত্মীয় হিসাবে তার বাড়িতে থাকতো। তা সত্ত্বেও শহরের মুন্সিপাড়ায় ফায়ার সার্ভিসের কাছে একটি গোপন ভাড়া বাড়ি রয়েছে সাইফুলের। সেখানে থাকে একাধিক তরুনি। সাইফুল তার বস সাদিকুরকে প্রায়ই নিয়ে যায় সেখানে সেখানে বেশ আনন্দ ফূর্তিতে সময় কাটতো তাদের।
জেলা ছাত্রলীগ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান ও তার দেহরক্ষী বাহিনীর দাপটে শহরের সরকারি মহিলা কলেজ ও নবারুণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মেয়েরা নিরাপদে যাতায়াত করতে পারতো না। কখন তার বাহিনী কার হাত ধরে টানে কিংবা উত্ত্যক্ত করে, এমনকি তুলে নিয়ে যায় এমন আতংকেই থাকতো তারা। এ কারণে তারা দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করতো। কোনো কোনো ছাত্রী বোরকা ব্যবহার করে নিজেদের আড়াল করে স্কুল কলেজে চলাফেরা করে। তাদের নিরাপত্তার জন্য অভিভাবকরা তাদের সাথে যাতায়াত শুরু করেন।
পুলিশ জানতে পেরেছে সাদিকুর বাহিনী আরও একাধিক বিকাশ এজেন্ট ব্যাংকে হামলার ছক কষছিল। এই হামলায় পাওয়া টাকা ও আগের টাকা নিয়ে তার অনুসারীদের মধ্যে বন্টনের পরিকল্পনার কথাও সে জানিয়েছিল তাদের। তার আগেই তার বিশ^স্ত দুই ক্যাডার দ্বীপ ও সাইফুল ধরা পড়ে যাওয়ায় সেসব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।
পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে সৈয়দ সাদিকুর ও তার বাহিনী কোনো ঘটনা ঘটানোর সময় তাদের ব্যবহৃত ফোনগুলি ব্যবহার করতো না। নতুন কোনো ফোন ও সিম কিনে কেবলমাত্র তা নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহার শেষে সিম ফেলে দিয়ে মোবাইলও ভেঙেচুরে ফেলতো।
সাদিকুর জেলার বিভিন্ন স্থানে তার বাহিনী সদস্যদের পাহারায় বসাতো। কে ফেনসিডিল আনছে কে কখন সোনা পাচার করছে এ তথ্য দ্রুত চলে আসতো তার কাছে। খবর আসতেই সাদিকুর হামলা করে তা ছিনতাইয়ের ছক কষতো। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হতো। সাতক্ষীরায় চোরাচালানের জন্য নিয়ে আসা স্বর্ণের একটি বড় চালান সম্প্রতি সৈয়দ সাদিকুর ও তার বাহিনী অস্ত্র দেখিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে।
কালিগঞ্জের বসন্তপুর সীমান্ত পথে ভারত থেকে সাদিকুর অস্ত্র ও ফেনসিডিল পাচার করতো বলে এলাকায় মানুষের মুখে মুখে কথিত রয়েছে। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে।
ঢাকায় রয়েছে তার অঢেল সম্পদ। ঢাকার কোথায় কোন বিলাসবহুল বাড়িতে সে থাকে তারও খোঁজ খবর নিচ্ছে পুলিশ। তার কাছে সব সময় থাকে অস্ত্র। কেউ কোনো প্রতিবাদী ভাষা দিলেই তাকে পিটিয়ে সাইজ করতো সাদিকুর ও তার বাহিনী। এমনকি তাকে গুলি করতেও পিছ পা হতো না। সাম্প্রতিককালে শহরে এমন একাধিক গুলির ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।
মুনজিতপুরে সৈয়দ সাদিকুরের বাড়িতে ছিল কিছু তরুণীর অবাধ যাতায়াত, এমনকি রাত্রিযাপনও। দিবাভাগে তারা সাদিকুর ও তার বাহিনীকে নিয়ে আনন্দ ফূর্তিতে মেতে থাকতো। তার বাড়িতেই গড়ে ওঠে বালাখানা। পরিবারের পক্ষ থেকে সাদিকুরের এই কাজে বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
ব্লাক মেইলিংয়ে ওস্তাদ ছিল সাদিকুর। অর্থশালী অথচ নানাভাবে দুর্বল মানসিকতার লোককে নারী লোভ দেখিয়ে ডেকে আনতো সে। তাদেরকে কোনো নারীর কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে নগ্ন অবস্থায় ভিডিও ধারন করতো সাদিকুর বাহিনী। এমন অনেক ঘটনার মধ্যে সম্প্রতি দুটি নিয়ে সাতক্ষীরায় মামলা হয়েছে। মামলা দুটি করেছেন আশাশুনির একজন ইউপি চেয়ারম্যান ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলার একজন ইউপি চেয়ারম্যান। দুটি পৃখক ঘটনার উল্লেখ করে তারা বলেন, নারীর কক্ষে ঢুকিয়ে নগ্ন হতে বাধ্য করে তার সাথে অশালীন কাজে লিপ্ত করার ভিডিও ধারণ করে সাদিকুর ও তার বহিনীর সদস্যরা।পরে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আদায় করা হয় চার লাখ টাকা। পুলিশ সাদিকুর বাহিনীর সদস্য ‘জয়যাত্রা টেলিভিশন’ এর সাতক্ষীরা সংবাদদাতা আকাশ ইসলাম নামের এক যুবককে পর্ণোগ্রাফি মামলায় গ্রেফতার করেছে। আকাশ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্র্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসবের নেপথ্য নায়ক সাদিকুর, সাংবাদিক মনি, তুহিন ও সোহরাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। ব্লাক মেইলিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হতো এমন একজন নারী সুমাইয়া শিমুকে আটক করেছে। শিমু গত ১৮ ডিসেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সাতক্ষীরা পুলিশ লাইন্স স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে সাদিকুরের বাড়ির পাশে সাতক্ষীরা নবারুণ স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে সুমাইয়া শিমু। এরই মধ্যে সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হলে সে সাদিকুরের নজরে পড়ে। সাদিকুরদের বাড়িতে যাতায়াত এবং তার দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে সাদিকুর তাকে ও তার মতো আরও কয়েক নারীকে ব্যবহার করে অর্থশালীদের সাথে ব্লাক মেইলিং করে।
সাদিকুর পুরোপুরি একজন মাদকাসক্ত যুবক। তার কথাবার্তা ও চলাফেরায় সব সময় তা প্রকাশ পেয়েছে। দিবাভাগে তাকে খুব কমই দেখা যেতো। রাত হতেই দেখা যায় তার ও তার ক্যাডারদের ভয়ংকর দাপট। তার বাহিনীকেও সে মাদকসেবী করে তুলেছে। একই মজমায় বসে গুরু শিষ্যের মাদক সেবনের কাহিনী শোনা যায় সাদিকুরের অনুসারীদের মুখ থেকেও।
সাদিকুরের বিকৃত যৌন লালসার শিকার হয়ে অনেক মেয়ে সাতক্ষীরা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সাদিকুর ও তার দেহরক্ষী সাইফুল এমন কতো মেয়ের সর্বনাশ করেছে তার হিসাব নেই বলে জানিয়েছে তারই ঘনিষ্ঠ কর্মীরা। সোহাগ নামের যে স্কুল প্রহরী খুন হয়েছিল তাও ছিল নারী ঘটিত বিষয়কেন্দ্রিক। এ বিষয়টি জানিয়েছে সাদিকুরের ঘনিষ্ঠজনেরা।
সে জেলাব্যাপী উপজেলা কমিটি তৈরি করে দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব কমিটি গঠনের দুই তিনমাস পর নতুন কমিটির কাছ থেকে ফের টাকা নিয়ে আরেক কমিটি দিয়েছে সাদিকুর। এমনকি কমিটি বহাল রাখার কথা বলেও সে আদায় করেছে টাকা। সম্প্রতি জেলায় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠনে সৈয়দ সাদিকুর স্বপদে বহাল থাকবেন এমন কথা বলেও উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটির কাছ থেকেও টাকা আদায় করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
সৈয়দ সাদিকুরের এসব কীর্তি কেলেংকারী নিয়ে এখন শহরের মোড়ে মোড়ে আলোচনা হচ্ছে। এসবের সত্য মিথ্যা নিয়ে যাচাই বাছাইও চলছে। জেলা ছাত্রলীগের মতো এমন একটি সংগঠনে সৈয়দ সাদিকুরের মতো একজন চাঁদাবাজ ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী মাদকাসক্ত অপদার্থ যুবক সেক্রেটারির পদ কিভাবে লাভ করলো যে বা যার ছত্রছায়ায় সে এসব অপকর্ম করেছে তাকেও বিচারের আওতায় আনার দাবি তুলেছেন সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
এতোসব অভিযোগের পর গত ৪ ডিসেম্বর কেন্দ্রিয় কমিটি সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুরকে বহিস্কার করেছে। জেলা কমিটিও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় সাদিকুর। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে চার লাখ টাকা। একই সাথে গ্রেফতার হয় সুমাইয়া শিমু। তারা দুজনেই জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব রায়ের আদালতে ব্লাক মেইলিংসহ অন্যান্য অপরাধের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সাদিকুরের বিরুদ্ধে বিকাশ এজেন্টের ২৬ লাখ টাকা ছিনতাই, বেআইনি অস্ত্র রাখা, চাঁদাবাজি ও পর্ণোগ্রাফি বিষযক চারটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এরই মধ্যে তার দুই সহযোগী ক্যাডার মুনজিতপুরের পিচ্চি রাসেল ও মাছখোলার মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে একটি বিদেশি পিস্তল ও ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সাদিকুর এখন পুলিশের জালে আটক। তার সাথে কথা বলা যায়নি। তবে আটক হবার আগে সাদিকুর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে সবই অপপ্রচার। তিনি বলেছিলেন ‘আমি কোথাও চাঁদাবাজি করি না। টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা শুনেছি মাত্র। কোনো বেআইনি অস্ত্র আমার নেই। ব্লাক মেইিলিং করা কিংবা ছাত্রলীগের স্থানীয় পর্যায়ের কমিটি ভাঙ্গাগড়ার নামে টাকা আদায়ের অভিযোগও সত্য নয়’। তিনি বলেন পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত সাইফুল ও দ্বীপ আমার ভাইয়ের মতো চিল। তিনি ফেইসবুকে তাদের জন্য দোয়া করেছিলেন।

Please follow and like us:

Check Also

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সম্মত ইইউ

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছে ইউরোপের দেশগুলোর জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। সোমবার ইউরোপীয় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।