পুরো বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে ভারতের ঘৃণার রাজনীতি

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ  মঙ্গলবার রাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে বিশাল ভূরিভোজ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও সেখানে সফররত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তাদের মেন্যুতে ছিল খাসির মাংসের বিরিয়ানি, ম্যারিনেট করা ভেড়ার পা, কাজুন দিয়ে রান্না করা সালমন, হ্যাজেলনাট অ্যাপল পাই। তারা যখন ভূরিভোজে ব্যস্ত ছিলেন তখন দিল্লিতে চলছিল নজিরবিহীন এক সহিংসতা। ট্রাম্পের ভারত সফরের শুরু থেকে শহরটিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় কয়েক ডজন মানুষ প্রাণ হারান। এমন একজন নিহতের নাম শহিদ খান। তার বয়স ২২ বছর। মঙ্গলবার নয়াদিল্লির গুরু তেজ বাহাদুর হাসপাতালে বসে তার হত্যার যৌক্তিকতা বোঝার চেষ্টা করছিল তার পরিবার। চার ভাইয়ের মধ্যে শহিদ ছিল সবচেয়ে ছোট।

পেশায় ছিলেন রিকশাচালক।

দিল্লির এ সহিংসতা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দৃষ্টান্ত। কিন্তু বাইরের পরিস্থিতি অগ্রাহ্য করে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে চলছিল ‘টোস্ট’ আর বন্ধুত্ব গড়ার মুহূর্ত। প্রচলিত রীতি ভেঙে ট্রাম্পের ভারত সফর মোটামুটি ঠিকঠাক ছিল। তেমন কোনো অসমীচীন বক্তব্য বা কাজ করেননি তিনি। বেশ নিয়ন্ত্রিত ছিলেন, স্ক্রিপ্ট মেনে চলেছেন। ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সব ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। অবশ্য, কোনো প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি ছাড়াই সফর শেষ করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশিক্ষণ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে থাকতে পারেননি। মোদি সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল গণমাধ্যমগুলোতেও তার সফরের বদলে জায়গা করে নিয়েছে দিল্লির সহিংসতা।

ট্রাম্পের সফর মোদি সরকারের জন্য ভারতের ‘সফট পাওয়ার’ দেখানোর এক বিশাল প্রদর্শনী ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ও বড় গণতন্ত্রের সম্মিলনের এক মুহূর্ত। ট্রাম্পের জন্য এটা ছিল ভারতীয়দের বিমোহিত করার এক সুযোগ। নির্বাচনের বছরে আমেরিকার প্রভাবশালী ও ধনী ভারতীয় সম্প্রদায়কে খুশি করার সুযোগ। অন্যদিকে, মোদির জন্য এ সফর ছিল, সম্প্রতি দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়, ধীরগতির অর্থনীতি ও বৈশ্বিক গণমাধ্যমে নেতিবাচক ভাবমূর্তি থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা।

কিন্তু, তাদের দুজনের প্রত্যাশায় বালু ঢেলে দিয়ে ভারতের ঘৃণার রাজনীতি পুরো বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। বহু বছর ধরে একসঙ্গে মিলেমিশে বাস করা দিল্লিতে হিন্দু ও মুসলিমরা ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। ধসে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা। অচল হয়ে পড়েছে পুলিশ। অনেকে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। সরকারি কর্মকর্তারা এই দাঙ্গাকে সিএএ সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যকার দাঙ্গা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রাথমিকভাবে দু’পক্ষেই সহিংসতার খবরও বের হয়। কিন্তু দিনের শেষে পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে উঠে, এই সহিংসতায় মুসলিমদের ওপর সুসংগঠিত ও ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা চালানো হচ্ছে।

সহিংসতা শুরুর পরপর দলে দলে হামলাকারীরা মুসলিমদের শনাক্ত করে তাদের বাড়িতে ঢুকে হামলা চালায়। অনেক মুসলিম সাহায্যের জন্য পুলিশের হটলাইনে ফোন দেন। পুলিশ কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। হয়তো তীব্র নির্বুদ্ধিতার কারণে বা ইচ্ছাকৃতভাবে। তবে হামলায় পুলিশরাও হতাহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০ জনের বেশি, নিহত হয়েছেন এক কনস্টেবল। তবে নিশ্চিতভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক ধস নেমেছিল এদিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ভিডিওগুলোয় দেখা গেছে পুলিশকর্মীরা লাঠি ও পাথর হাতে আগ্রাসী ভাবমূর্তির দলগুলোর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। এক ভিডিওতে দেখা যায়, একদল পুরুষ রাস্তায় পড়ে করুণার আবেদন করছে আর তাদের থেকে কিছু দূরে জাতীয়তাবাদী গান গাইছে পুলিশ।

দিল্লি পুলিশ জবাবদিহিতা করে প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র কাছে। বর্তমান ভারত সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ব্যক্তি তিনি। দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে তিনি একাধিক বৈঠক করেছেন, শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু অন্যান্য ইস্যুতে বাকপটু এই মন্ত্রী দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে ওই আহ্বান জানানোর চেয়ে বেশি কোনো মন্তব্য করেননি। প্রধানমন্ত্রী মোদিও মঙ্গলবার এ দাঙ্গা নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। এদিন বিকালে একক এক সংবাদ সম্মেলনে এই সহিংসতা ও সিএএ নিয়ে প্রশ্ন করলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, তিনি এ ব্যাপারে মোদির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তিনি জানান, মোদির সঙ্গে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে তার বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। মোদি এ ব্যাপারে অসাধারণ ছিলেন। ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় কঠোর পরিশ্রম করছেন।

ব্যাস, এই। ট্রাম্পের এই সহজাত স্বর ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উচ্চ পর্যায়ের এই নীরবতা বর্তমান পরিস্থিতি সাপেক্ষে ভীতিকর। কিন্তু এ নিয়ে তাদের তেমন সতর্ক হতে দেখা যায়নি। কয়েকদিন আগেই ভারতের ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা, কপিল মিশরা, সিএএ বিরোধী বিক্ষোভকারীদের আইনভঙ্গ করে রাস্তা ছাড়তে হুমকি দেন। এ সময় তার পাশেই এক পুলিশকর্মীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

কয়েক মাস ধরে সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ, ধর্মঘট চলছে নয়াদিল্লিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে শাহিনবাগে মুসলিম নারীদের নেতৃত্বে হওয়া বিক্ষোভ। তাদের কর্মকাণ্ড মূলত শান্তিমূলকই রয়েছে। পতাকা, স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংবিধানের মতো  ভারতীয় মর্যাদার প্রতীকের ওপর ভিত্তি করেই তারা বিক্ষোভ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সোমবার যখন দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে, তখন একইসঙ্গে সিএএ সমর্থন করে শহরের বেশ কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভ শুরু হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সিএএ বিরোধী বিক্ষোভকারীদের রাস্তা থেকে হটানো। অনেকে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন। বলেছেন, হয় বিক্ষোভকারীদের রাস্তা ছাড়তে হবে, নয়তো দেশ ছাড়তে হবে।

রিকশাচালক শহিদের মতো দিল্লি সহিংসতায় মারা যাওয়া আরেক ব্যক্তির ভাই মোহাম্মদ ফুরকান। এই দাঙ্গার জন্য মোদির নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন দল বিজেপিকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, মিশরা এই সহিংসতা উস্কে দিয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার হুমকির সময় মিশরা বলেছিলেন, আমরা ট্রাম্প চলে যাওয়া পর্যন্ত শান্তি ধরে রাখবো। কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। শান্তি এর আগেই বিদায় নিয়েছে।

(দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট অবলম্বনে। মূল প্রতিবেদনটি লিখেছেন বারখা দত্ত।)

Please follow and like us:

Check Also

খাবার স্যালাইন বিতরণ কলারোয়া উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর

সারা দেশের মতো কলারোয়াতেও তীব্র তাপদাহ চলছে। গরমে সবারই হাঁসফাঁস অবস্থা। তবে থেমে নেই জনজীবন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।