রাজনীতির ফাঁদে আদালত

বুধবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বন্যা পরিস্থিতিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন। রাষ্ট্রপতিকে বন্যা পরিস্থিতি অবহিত করতে যাওয়ার চলটা অনেক দিন আগেই শেষ হয়েছে বলেই আমরা জানতাম। কেননা, দেশে নির্বাহী ক্ষমতা এখন আর রাষ্ট্রপতি প্রয়োগ করেন না। পরে দেখা গেল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন। বঙ্গভবন থেকে বেরোনোর সময় ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রথম আলোর অনলাইন পাঠকদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, বন্যা পরিস্থিতির আলোচনায়

পানিসম্পদমন্ত্রী নেই, ত্রাণমন্ত্রী নেই, স্বাস্থ্যমন্ত্রীও নেই—তাহলে আইনমন্ত্রী আর অ্যাটর্নি জেনারেলের সেখানে প্রয়োজন হলো কেন? এ প্রশ্নের উত্তর কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং ওই সভায় অংশগ্রহণকারী অন্য দুই মন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলই জানেন।

তবে বন্যা ছাড়াও ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, তা ওবায়দুল কাদেরের মুখ থেকেই আমরা জেনেছি। আমরা তাঁর কাছ থেকে আরও জেনেছি, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর আরও আলোচনা হবে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মন্ত্রিসভার সদস্যদের যে কারও যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে যে ধরনের রাজনীতি শুরু হয়েছে, তার পটভূমিতে এই মন্তব্যকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না। বরং, নানাধরণের প্রশ্ন তৈরি হয়।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল সংক্ষুব্ধ হয়েছে এবং তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি যারপরনাই উৎফুল্ল হয়েছে , তা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বিএনপি সমর্থক আইনজীবী ফোরামের নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেনের ভাষায়, রায় সরকারকে হেস্তনেস্ত করেছে। তিনি সরল ভাষায় স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন যে বিএনপি এখন সুযোগটাকে কাজে লাগাতে চায়। এসব প্রতিক্রিয়াই এখন রাজনীতির মূল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই রাজনৈতিক ডামাডোলের ফাঁদে আদালত পা দেবেন না বলে জানানোয় আমরা কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করছিলাম। কিন্তু প্রকাশ্য আদালতে ওই প্রত্যয় ঘোষণার পর দিন দুয়েক পার না হতেই প্রধান বিচারপতির বাড়িতে ১২ আগস্ট রাতের বেলায় হাজির হলেন সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে তিনি খুব একটা প্রকাশ করেননি। কিন্তু এটুকু জানিয়েছেন যে রায়ের বিষয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থানের কথা তিনি প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, আরও আলোচনা হবে। আমরা এই প্রথম জানলাম সুপ্রিম কোর্টের একটি সর্বসম্মত রায়ের বিষয়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। আমরা আরও জানলাম তাঁদের দেওয়া রায়ের বিষয়ে প্রধান বিচারপতিকে একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থানের কথাও জানানো যায়।

রাজনীতির ফাঁদে পা দেওয়ার আর কিছু বাকি থাকল কি না, সেই প্রশ্ন তোলার আর কোনো মানে হয় না। বরং প্রশ্ন যেটা উঠেছে তার কথাই বলি। ইত্তেফাকপত্রিকারআইন-আদালতবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন সালেহউদ্দিন। তিনি ফেসবুকে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘এখন যদি অন্য দলের মহাসচিব তাঁর দলের অবস্থান জানাতে চান, তাহলে বিষয়টি কই গিয়ে দাঁড়াবে?’ ওই অন্য দলটি যদি বিএনপি হয় তাহলে বোধ করি ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের রাজপথ গরম করতে এক মুহূর্তও দেরি হবে না। বিপরীত কাজটি বিএনপির পক্ষে করা মুশকিল। কেননা, তাদের আবার সভা-সমাবেশের জন্য পুলিশের অনুমতি লাগে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক একজন সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের বৈঠক সম্পর্কে বলেছেন, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর হতে পারে না। এটা আমাদের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এটা জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ায় আদালত অবমাননা ঘটেছে বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন। খন্দকার মাহবুব হোসেনের কথায়ও ফাঁক দেখছি। বৈঠকের খবরটি প্রকাশিত না হলে কি বিষয়টি শুদ্ধ হতো?

সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে যোগাযোগ থাকবে, সেটা মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু সেই যোগাযোগটি সাধারণভাবে হয়ে থাকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল কিংবা আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। আমরা জানি, প্রকাশ্য আদালতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই প্রধান বিচারপতি আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সেটি ছিল অধস্তন আদালতের শৃঙ্খলাবিধির বিষয়ে গেজেট প্রকাশে সরকারের অনিচ্ছা বা গড়িমসির বিষয় নিয়ে। সে সময়ে আইনমন্ত্রী একটি বৈঠকের সময় নির্ধারণ করেও শারীরিক অসুস্থতার কারণ জানিয়ে নির্ধারিত দিনে প্রধান বিচারপতির দপ্তরে যাননি। অধস্তন আদালতের শৃঙ্খলাবিধি-বিষয়ক সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে সরকারের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের টানাপোড়েন অনেক দিনের। সেই টানাপোড়েনের সঙ্গে যুক্ত হলো সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে নেওয়ার বিধানসংবলিত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ধাক্কা। স্বভাবতই সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর ভাষায়, সরকার ‘আহত, ক্ষুব্ধ এবং ক্ষতিগ্রস্ত’। পেশায় আইনজীবী হওয়ার কারণে আদালতের আচরণবিধি তাঁর জানা থাকায় ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের বিষয়ে তিনি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত তদবির বা আলোচনার পথে যাননি। অন্তত দুই দফায় তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার রায়ের অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জের জন্য আইনি পথে চেষ্টা চালাবে। রিভিউ নাকি এক্সপাঞ্জের জন্য আবেদন করা হবে তা সরকারের বিবেচনাধীন বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, তাঁর দলের নেতাদের ওই কৌশলের ওপর ভরসা নেই। তাঁরা মাঠ গরম করে চাপ প্রয়োগের কৌশলকেই বেশি কার্যকর মনে করছেন। ফলে রায়ে যে কথা নেই সে সব ব্যাখ্যা দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করার পথে হাঁটছেন তাঁরা। তাঁদের ধারণা, রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে আদালতকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রায় সংশোধনে বাধ্য করা হয়তো সম্ভব। ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার উদ্দেশ্যও যে সেই চাপ সৃষ্টি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আদালতের ওপর চাপ প্রয়োগ করে রায় নিয়ে দর-কষাকষির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলে তাতে রাষ্ট্রের যে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হবে, বিষয়টি সবারই মনে রাখা উচিত। এখন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আরও আলোচনার কথায় কী ইঙ্গিত রয়েছে, সেটাই বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের কারণও আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাস, যেখানে আমরা স্মরণ করতে পারি যে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাংবিধানিক পদে আসীন একাধিক ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির চায়ের দাওয়াত পেয়ে পরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে প্রধান বিচারপতির কলম থেকেই আমরা জেনেছি যে উচ্চ আদালতের মামলার ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র বা সরকার একটি পক্ষ। মামলায় সব পক্ষই জিততে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন কোনো রায় সরকারের মনঃপূত না হলে আদালতের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সরকার যদি তার পক্ষে রায় বদলাতে সক্ষম হয়, তাহলে হাজার হাজার বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার পাওয়ার আর কোনো পথই যে খোলা থাকবে না? এ ক্ষেত্রে আরও বড় বিপদ হলো, শুধু সরকার নয়, এখন থেকে আদালতকে ক্ষমতাসীন দলকেও খুশি করতে হবে। সেটা তো কারও কাম্য হতে পারে না।

Please follow and like us:

Check Also

ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তান নিয়ে ট্রেনের নিচে নারীর ঝাঁপ: মারা যান মা-ছেলে

হাজীগঞ্জে এক বছরের সন্তান আব্দুর রহমানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেন মা তাহমিনা (২৩)। এতে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।