সুন্দরী হিরার প্রতারণার ফাঁদ

ক্রাইমবার্তা রিপোট: পাত্রী সুন্দরী। কথা বলেন ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণে। গল্প করেন নিউ ইয়র্ক, নিউজার্সিসহ আমেরিকার বিভিন্ন শহরের। তাকে বিয়ে করতে পাত্রের আগ্রহের কমতি থাকে না। বিশ্বের প্রভাবশালী, ধনী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেতে পাত্রীকে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা থাকে পাত্রের। এজন্য লাখ-লাখ টাকাও ব্যয় করেন। বিয়েও হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাসররাতও উপভোগ করেন। বিয়ে উপলক্ষে স্বর্ণালংকার ছাড়া নগদ অর্থ গ্রহণ করা হয় পাত্রের কাছ থেকে। তারপরই ঘটে আসল ঘটনা। হঠাৎ পাত্রী এবং তার স্বজনরা উধাও হয়ে যান। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। এ রকম একটি চক্রের চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
শুরুটা হয় বিজ্ঞাপন দিয়ে। ‘শিল্পপতির সুন্দরী কন্যা। আমেরিকান সিটিজেন। বয়স ৩৭। লম্বা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। বিধবা। মা সচিব। ঢাকায় গাড়ির শো’রুম ও যমুনা ফিউচার পার্কে দোকান রয়েছে। গ্রামের বাড়ি খুলনা। ছুটিতে এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার জন্য ধার্মিক-নামাজী ও ব্যবসায়ী পাত্র চাই।’ এভাবেই দেয়া হয় চটকদার বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে পাত্রীর আত্মীয় বা মামা-চাচা পরিচয়ে দেয়া ফোন নম্বরে কল আসে অনেক। কিন্তু সব কলে সাড়া দেন না তারা। যে পাত্রের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করা যাবে তারই অগ্রাধিকার তাদের কাছে। একই পাত্রীর জন্য একাধিক পাত্রের সঙ্গেও চলে বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনা। এই চক্রের প্রতারক পাত্রীর নাম আইরিন আক্তার শাহানা ওরফে হিরা। পাত্রীর ভূমিকায় অভিনয়ে তার দক্ষতা বেশ।
গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব’র কাছে শাহানা স্বীকার করেছে, তাকে দিয়েই একের পর এক প্রতারণা করেছে এই চক্র। অনেক ক্ষেত্রে পাত্রী শাহানাকে দেখানোর জন্য পাত্রকে থ্রি-স্টার হোটেলে ডেকে আনা হয়। ওই হোটেলের বিল বাবত আগেই টাকা আদায় করা হয় পাত্রের কাছ থেকে। কথাবার্তার পর দ্রুত বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিয়ে উপলক্ষে স্বর্ণালঙ্কার বাবদ ১০-১২ লাখ টাকা আদায়ের চেষ্টা করে। বিয়ে-কাবিন সবই হয়। তবে সবই ভুয়া। জালিয়াতি করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাসরেরও আয়োজন করা হয়। এরমধ্যেই সুযোগ বুঝে অর্থ-স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায় পাত্রী ও তার স্বজন পরিচয় দানকারীরা। তারপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় তাদের ফোন। কাবিননামায় দেয়া ঠিকানায় খুঁজে এ রকম কারও অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। এ রকম অন্তত ১২টি ঘটনার কথা স্বীকার করেছে এই চক্রের গ্রেপ্তারকৃত সদস্যরা।
গত ২৭শে জুন একটি জাতীয় দৈনিকে শাহানাকে আমেরিকান সিটিজেন পাত্রী সাজিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। বিজ্ঞাপনে দেয়া ফোন নম্বরে কল দিলে পাত্রীর মামা পরিচয়ে মাহবুব নামে এক ব্যক্তি কথা বলে। আস্থা অর্জন করতে ব্যস্ততা দেখায় মাহবুব। জানায় সে বরিশালে আছে পারিবারিক কাজে। এ বিষয়ে পরে কথা বলবে। পরবর্তীতে ফোনে যোগাযোগ হলে মাহবুব ওই পাত্রকে দেখা করতে বলে। গত ১১ই অক্টোবর মিরপুর-১০ নম্বরের ডায়াবেটিস হাসপাতালের রিসিপসনে দেখা হয় পাত্রীর স্বজন পরিচয় দেয়া মাহবুব ও রাজুর সঙ্গে।
এ সময় পাত্রের পাসপোর্ট আছে কি-না জানতে চায় তারা। পাসপোর্ট নেই জানার পর হতাশা প্রকাশ করে। তাৎক্ষণিকভাবে নিজেরাই মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে নেয়। দ্রুত পাসপোর্ট করার জন্য ৫ হাজার টাকা নেয় তারা। শুরুটা এভাবেই। পরদিন জানানো হয় শুভ সংবাদ। মোবাইলফোনে ধারণ করা ছবি দেখেই পাত্রকে পছন্দ করেছে পাত্রী শাহানা।
এবার শাহানার কল। শুরু হয় আলাপচারিতা। অল্পতেই পাত্রকে প্রেমে মজাতে চেষ্টার কমতি নেই শাহানার। ফোনে আলাপ শুধু শাহানার সঙ্গে না। কথা হয় পাত্রীর মা পরিচয়ে ফরিদা বেগমের সঙ্গেও। বিয়ে করেই দেশ থেকে পাত্রকে নিয়ে যাবে শাহানা। বিয়ের পর এভাবে দূরে থাকা যাবে না মোটেও। তাই দ্রুত বিয়ের প্রস্তুতি নিতে বলা হয় পাত্রকে। এমনকি প্রথম দেখাতেই যেন তাকে আংটি পরানো হয়- এ রকম ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে শাহানা।
শাহানার মা পরিচয়ে ফরিদা জানায়, ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু সময় কম। তাই সেভাবে না হলে বিয়েতে খরচের কোন কমতি হবে না। বাকিটা শাহনা নিজেই পাত্রকে বলে, বিয়েতে আমি ১০ লাখ টাকা খরচ করব। আপনি ৫ লাখ টাকা খরচ করবেন। এতো টাকার অঙ্ক শুনে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান মধ্যবিত্ত পরিবারের ওই পাত্র। তিনি জানান, ২ লাখ টাকা খরচ করতে পারবেন। পাত্রী শাহানা তা মেনে নেয়। কিন্তু ওই দুই লাখ টাকাও ম্যানেজ করা কঠিন হয়ে যায় পাত্রের কাছে। তাই বেশ কিছুদিন যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তিনি। কিন্তু অবাক করে দিয়ে পাত্রীর স্বজনা পরিচায়দানকারীরাই যোগাযোগ করে। পাত্রকে দেখা করতে বলে। আমেরিকান সিটিজেন পাত্রীর স্বজনদের এ রকম আগ্রহ দেখে সন্দেহ সৃষ্টি হয় ওই পাত্রের। এর আগেও এ রকম প্রতারণার সংবাদ পড়েছেন পত্রিকায়।
তাই বিষয়টি র‌্যাব-১ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন পাত্র। র‌্যাব-১’র পরামর্শে ২২শে নভেম্বর রাতে মিরপুর-৬ এর চার নম্বর সড়কের দুই/এ নম্বর বাড়ির সামনে দেখা করতে যান ওই পাত্র। আশপাশে অবস্থান নেন র‌্যাব সদস্যরা। ওই সময়ে গ্রেপ্তার করা হয় প্রতারক চক্রের চার সদস্যকে।
র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক কর্নেল তুহিন মাসুদ বলেন, চক্রটি অন্তত দু্‌ই বছর ধরে এভাবে প্রতারণা করে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে পাত্রকে পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট করা ফ্ল্যাটে বা বাসায় নিয়ে প্রলোভনে  ফেলে দেয়। পাত্রী পরিচয়দানকারী ওই তরুণী ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ে কৌশলে কথিত পাত্রীর সঙ্গে একান্ত কিছু মুহূর্তের ছবি এবং ভিডিও ধারণ করে চক্রের সদস্যরা। তারপর এসব ছবি, ভিডিও ফুটেজ দিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করে লাখ লাখ টাকা আদায় করা হয়। এই চক্রে আরো ১০-১২ জন জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভুয়া কাজী খুলনার ফুলতলা থানার বুড়িয়ার গ্রামের শেখ হাফিজুর রহমান। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি। গ্রেপ্তারকৃতদের ফ্ল্যাট থেকে নোটারি পাবলিকের সকল প্রকার সীল, জাল ফরম, ভুয়া কাবিননামা জব্দ করা হয়েছে।
র‌্যাব-১’র সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আকরামুল হাসানের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হচ্ছে- ঝালকাঠী জেলার রমজানকাঠী গ্রামের মাহাবুব শরীফ ওরফে শামীম (৩০), সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের নওয়াবেকী গ্রামের রেজাউল কবীর ওরফে আবদুর রাজ্জাক রাজু (৫০), বরগুনা জেলার বেতাগী থানার ভাসনডা গ্রামের আবদুল হালিমের স্ত্রী আইরিন আক্তার ওরফে শাহানা ওরফে হিরা (২১) ও ঝালকাঠি জেলা সদরের পূর্ব চাঁদকাঠী গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪৫)।

Please follow and like us:

Check Also

শ্যামনগরে পেট্রোল বোমায় মাহবুব-ই-এলাহী দগ্ধ

শ্যামনগরে সন্ত্রাসীদের পেট্রোল বোমায় দৈনিক দক্ষিণের মশাল সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহীর ভাই ও স্থানীয় বাজার রক্ষা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।