ক্রাইমবার্তা রিপোট:ঢাকা শহর রক্ষাবাঁধে চলাচলকারী যানবাহনের মালিকরা জিম্মি
গাবতলী থেকে বাবুবাজার। প্রায় ১২ কিলোমিটার ঢাকা শহর রক্ষাবাঁধের উপর দিয়ে চলে বাস, ট্রাক, টেম্পুসহ বিভিন্ন যানবাহন। এসব যানবাহনে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বাঁধ দিয়ে পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহন চলাচল করতে গেলে রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা ও পেশাদার সন্ত্রাসীদেরও নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। না দিলে হামলা-মামলাসহ বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধের ১৬টি পয়েন্টে নেতা-সন্ত্রাসীরা মিলে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ টাকার চাঁদা আদায় করছে। তবে পুলিশ বলছে, চাঁদাবাজির বিষয়ে তারা কোনো অভিযোগ পাননি। পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিমে শহর রক্ষা বাঁধের পুরান ঢাকার মিটফোর্ড বাবুবাজার থেকে গাবতলীর দূরত্ব ১১ দশমিক ৬০ কিলোমিটার। দীর্ঘ এ পথে প্রতিদিন কয়েক হাজার পণ্য ও যাত্রীবাহী বিভিন্ন পরিবহন চলাচল করে। নগরীর তীব্র যানজট এড়াতে দ্রুততম সময়ে পুরান ঢাকার আদালত চত্বর, শিক্ষা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পাইকারি কাপড়, মাছ-ফলের আড়তসহ বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছতে পরিবহন মালিক-চালক ও যাত্রীরা দীর্ঘ এ পথ নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করেন।
নগরবাসীর চাহিদা মেটাতে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এ পথ দিয়ে প্রতিদিন দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে নগরীর ঐতিহ্যবাহী পাইকারি মার্কেট মৌলভীবাজার, বাবুবাজার, ইসলামপুরে আসা যাওয়া করে। এছাড়া পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর হওয়ার পর থেকেই দীর্ঘ এ পথে দর্শনার্থী ও যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। যাত্রী ভোগান্তি কমাতে কয়েক ধাপে বিভক্ত করে যাত্রী পরিবহনের সংখ্যা বাড়িয়েছেন পরিবহন মালিকরা। এর মধ্যে শহর রক্ষা বাঁধে সাভার টু বাবুবাজার (ভায়া গাবতলী) রুটে ২০টি যানযাবিল, ৪০টি ব্রাদার্স ও ৩০টি প্রত্যয় পরিবহন নামে সর্বমোট ৯০টি বাস প্রতিদিন চলাচল করছে। গাবতলী টু হাজারিবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ রুটে ফিটনেসবিহীন হিউম্যান হলার (চ্যাম্পিয়ন পরিবহন) নামে প্রায় ৭০টি লক্কড়-ঝক্কড় মিনিবাস, মোহাম্মদপুর টু নবাবগঞ্জ সেকশন রুটে সরকার নিষিদ্ধ ৫৬টি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার টু নবাবগঞ্জ সেকশন রুটে ৬৫টি সিএনজি অটোরিকশা, নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ টু মিটফোর্ড বাবুবাজার রুটে নিয়মিত প্রায় ৩০টি লেগুনা ও বাবুবাজার ব্রিজের উপর-নিচ থেকে জুরাইন, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ীসহ ১০টি রুটে প্রায় ৩শ’ পরিবহন যান চলাচল করে। অপরদিকে, এ পথে প্রতিদিন পণ্যবাহী সহস্রাধিক ট্রাক-কভার্ডভ্যান ও পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শহর রক্ষা বাঁধে গাবতলী থেকে মিটফোর্ডের বাবুবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ১২ কিঃমিঃ পথ ডিএমপি’র ৮টি থানার অধীনে থাকায় সংশ্লিষ্ট থানা-ফাঁড়ি পুলিশ ও সরকারি দলের কতিপয় প্রভাবশালী নেতার লোকজন এবং চিহ্নিত চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছেন পরিবহন মালিক-চালক ও শ্রমিকরা। তারা বলছেন, রক্ষক হয়ে যারা ভক্ষক হন, তাদের কাছে অভিযোগ করে কোন লাভ নেই। সূত্র আরো জানায়, লালবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন টু মিটফোর্ডের বাবুবাজার রুটে প্রতিদিন প্রায় ৩০টি লেগুনা চলাচল করে। এসব লেগুনা থেকে ৪ থানা ও ফাঁড়ি পুলিশ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং নেতারা মিলে গড়ে প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকার চাঁদা তুলছেন। সোয়ারিঘাটের একটি চায়ের স্টলে বসে কথা হয় লেগুনার মালিক জুলহাস মোল্লার ছেলে সুমনের সাথে। পরিচয় গোপন রেখে চাঁদাবাজির বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ ও সরকারি দলের নেতা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে চাঁদা না দিয়ে কোন পরিবহন এ রুটে ঠিকমত চলাচল করতে পারে না। সুমন বলেন, ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামে লেগুনা থেকে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা হারে মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামে প্রতিদিন ৪ হাজার টাকা হারে মাসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া ইসলামবাগের কথিত যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর মোল্লাও এসব লেগুনা থেকে নিয়মিত মোটা অংকের চাঁদা তোলেন। এদিকে মিটফোর্ডের বাবুবাজার বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নিচে দেখা গেছে, গাবতলী টু বাবুবাজার রুটে চলাচলকারী ব্রাদার্স, যানযাবিল ও প্রত্যয় নামের ৩টি যাত্রীবাহী বাসের কাউন্টার রয়েছে। এসব পরিবহন থেকে লাইনম্যান হিসেবে পুলিশ ও সরকারি দলের এক নেতার নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে চাঁদা তোলেন হিটলার, মেহেদী ও মানিক। তিনটি কাউন্টার থেকে টিআই, পিআই, এসি পেট্রোল ও আনসার প্লাটুন কমান্ডার দীলিপের নামে গড়ে প্রতিদিন ৯শ’ টাকা হারে মাসে ২৭ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া বংশাল ও কোতয়ালী থানাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার দু’ফাঁড়ির নামে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা হারে মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নিচে অবৈধ ফুটপাথের দোকান থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার টাকা হারে মাসে ৯ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন লাইনম্যান মেহেদী। এখানে সরকারি জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা দোকানের মধ্যে রয়েছে, টং দোকান, চায়ের স্টল, রিকশার গ্যারেজ, পাইকারি চাউলের গোডাউন ও ভাংগারি দোকানপাট। আলাপকালে একজন লেগুনা চালক জানান, লেগুনা থেকে কোতয়ালী থানার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা প্রিন্স রবিন গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ও ব্রাদার্স পরিবহন থেকে ৪শ’ টাকা করে চাঁদা আদায় করেন। তার পক্ষে চাঁদা তোলেন ক্যাডার হিটলার। বাবুবাজার থেকে জুরাইনসহ ১০টি রুটে চলাচলরত বিভিন্ন যাত্রী পরিবহন থেকে লালবাগ-কোতয়ালী জোনে কর্মরত ২৭জন ট্রাফিক সার্জেন্টের নামে প্রতি সপ্তাহে মোটা অংকের চাঁদা তোলা হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনে চকবাজার-মিটফোর্ড সড়কসহ অলি-গলিতে কয়েক হাজার হকার বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করে। এসব দোকান থেকে প্রায় ৮০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন লাইনম্যান মেহেদী। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আরো ৬/৭জন লাইনম্যান। ব্রিজের নিচে ফুট দোকান থেকে ৩০ টাকা হারে প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন পরিবহনের লাইনম্যান মানিক।
সূত্র জানায়, ব্রাদার্স পরিবহন থেকে স্থানীয় চিহ্নিত ক্যাডার টাইগার হাবিবের ভাই কথিত আ’লীগ নেতা পিচ্চি ৪শ’ টাকা, যানযাবিল পরিবহন থেকে ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী বিল্লাল শাহ্’র শ্যালক লাবলু ৪শ’ টাকা, বিল্লাল শাহ্’র ভাতিজা মানিক শাহ্ ২ হাজার টাকা, তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক আলাউদ্দিন ব্রাদার্স পরিবহন থেকে ৪শ’ টাকা ও কাউন্সিলরের জন্য ৩টি পরিবহন থেকে লাইনম্যান আব্দুল কাদের প্রতিদিন ২ হাজার টাকা হারে মাসে ৬০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামে লেগুনা থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩শ’ টাকা হারে চাঁদা তোলেন। এছাড়া লালবাগ থানা ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আ’লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী পরিচয় দানকারী কামাল, বিপ্লব, লালু, শাহীন, সামিউল্লাহ্, জাকির এবং রুহুল গড়ে প্রতিদিন ৯ হাজার টাকা করে চাঁদা তোলেন। নবাবগঞ্জ পার্কের বিপরীতে বেড়িবাঁধে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা চোরাই মোবাইল মার্কেটের শতাধিক দোকান থেকে এবং মঙ্গলবার বেড়িবাঁধের হলি-ডে মার্কেটের ৫২৫টি দোকান থেকে গড়ে প্রতিদিন ৯৬ হাজার টাকার চাঁদা তোলেন ওই চক্রের সদস্যরা। নবাবগঞ্জ সেকশন থেকে খোলামোড়া, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার রুটে ও নবাবগঞ্জ সেকশন পুলিশ ফাঁড়ি থেকে গুলিস্তান রুটে ৫ শতাধিক যাত্রী পরিবহন থেকে কামরাঙ্গীরচরের প্রভাবশালী এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর, হাজারিবাগের ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তরিকুল ইসলাম সজিব, আদাবরের ডিএনসিসি’র ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজিব ও তাদের ক্যাডার বাহিনী যাত্রী পরিবহন থেকে গড়ে প্রতিদিন ১ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন। ৫টি রুটে ৩ শতাধিক যাত্রী পরিবহনের মধ্যে নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ থেকে খোলামোড়া রুটে সরকার নিষিদ্ধ ২৫টি থ্রি-হুইলার টেম্পো, ৫৪টি অটোরিকশা, মোহাম্মদপুর রুটে চলাচল নিষিদ্ধ ১৬৪টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার রুটে ৫০টি সিএনজি অটোরিকশা, গাবতলী রুটে চ্যাম্পিয়ন পরিবহন নামে ৬৮টি হিউম্যান হলার, গুলিস্তান রুটে ১২৭টি লেগুনা ও চকবাজার টু সেকশন রুটে ৩৭টি সিএনজি অটোরিকশা নিয়মিত চলাচল করছে। এসব রুটের প্রতি পরিবহন থেকে গড়ে প্রতিদিন ৪৫ হাজার টাকা হারে চাঁদা তোলেন শাহআলম, সেলিম, আলম, রাসেল, নাজিম, টুটুল, মজিবর, জাবেদ ও জামালসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার কাউন্সিলরদের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় ১০জন লাইনম্যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের কয়েকজন মালিক-চালক জানান, দ্রুততম সময়ে পুরান ঢাকার যাত্রীদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যেই তারা শহর রক্ষা বাঁধের এ রুটটি বেছে নেন। কিন্তু দীর্ঘ এ পথে ৮ থানা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সরকারদলীয় কথিত নেতাকর্মীদের হাতে রীতিমতো তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। চাঁদা না দিলে এ পথে তাদের পরিবহন চলাচলে নিয়মিত প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে। এর সাথে আছে গাড়ির কাগজপত্র তল্লাশির নামে সংশ্লিষ্ট থানা-ফাঁড়ি ও ট্রাফিক পুলিশের চরম হয়রানি। শহর রক্ষাবাঁধে নিয়মিত চলাচলকারী দূরপাল্লার ট্রাক ও কভার্ডভ্যান চালক আব্দুল হান্নান ও আমির হোসেন বলেন, তারা দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে শহর রক্ষাবাঁধ দিয়ে পুরান ঢাকার পাইকারি বাণিজ্যিক কেন্দ্র মৌলভীবাজার, চকবাজার, সোয়ারিঘাট, মিটফোর্ড, বাবুবাজার ও ইসলামপুরে যাতায়াত করেন। গাবতলী থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ এ পথে ১৬টি পয়েন্টে সংশ্লিষ্ট থানা ও ফাঁড়ি পুলিশকে পণ্যের প্রকারভেদে সর্বনিম্ম ৫শ’ হতে ১৫/২০ হাজার টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়। অন্যথায় পণ্য ও যানবাহনের কাগজপত্র তল্লাশির নামে বৈধ জিনিসকেও অবৈধ বলে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পরিবহন ব্যবসায়ী ও চালক বলেন, চাঁদাবাজির অত্যাচারে তারা পণ্য ও যাত্রী পরিবহন চালাতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। তাই সড়ক পথে পুলিশ ও শাসক দলের নেতাকর্মীসহ পেশাদার সন্ত্রাসীদের ঝামেলা এড়াতে তারা বাধ্য হয়েই নিয়মিত চাঁদার টাকা তুলে দিচ্ছেন। যার প্রভাব পড়ছে নিত্যপণ্য ও যাত্রীদের ভাড়ার উপর। জানতে চাইলে লালবাগ জোনের এডিসি (ট্রাফিক) মো: আশরাফ হোসেন বলেন, শহর রক্ষাবাঁধে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনে চাঁদাবাজি হয় এমন অভিযোগ এখনো পাইনি। তবে অভিযোগ পেলে বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া কোন পরিবহন ব্যবসায়ী যদি পরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে চাঁদাবাজির শিকার হলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পরামর্শ দিয়ে এডিসি (ট্রাফিক) বলেন, অভিযোগ পেলে ভুক্তভোগীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিমে শহর রক্ষা বাঁধের পুরান ঢাকার মিটফোর্ড বাবুবাজার থেকে গাবতলীর দূরত্ব ১১ দশমিক ৬০ কিলোমিটার। দীর্ঘ এ পথে প্রতিদিন কয়েক হাজার পণ্য ও যাত্রীবাহী বিভিন্ন পরিবহন চলাচল করে। নগরীর তীব্র যানজট এড়াতে দ্রুততম সময়ে পুরান ঢাকার আদালত চত্বর, শিক্ষা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পাইকারি কাপড়, মাছ-ফলের আড়তসহ বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছতে পরিবহন মালিক-চালক ও যাত্রীরা দীর্ঘ এ পথ নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করেন।
নগরবাসীর চাহিদা মেটাতে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এ পথ দিয়ে প্রতিদিন দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে নগরীর ঐতিহ্যবাহী পাইকারি মার্কেট মৌলভীবাজার, বাবুবাজার, ইসলামপুরে আসা যাওয়া করে। এছাড়া পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর হওয়ার পর থেকেই দীর্ঘ এ পথে দর্শনার্থী ও যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। যাত্রী ভোগান্তি কমাতে কয়েক ধাপে বিভক্ত করে যাত্রী পরিবহনের সংখ্যা বাড়িয়েছেন পরিবহন মালিকরা। এর মধ্যে শহর রক্ষা বাঁধে সাভার টু বাবুবাজার (ভায়া গাবতলী) রুটে ২০টি যানযাবিল, ৪০টি ব্রাদার্স ও ৩০টি প্রত্যয় পরিবহন নামে সর্বমোট ৯০টি বাস প্রতিদিন চলাচল করছে। গাবতলী টু হাজারিবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ রুটে ফিটনেসবিহীন হিউম্যান হলার (চ্যাম্পিয়ন পরিবহন) নামে প্রায় ৭০টি লক্কড়-ঝক্কড় মিনিবাস, মোহাম্মদপুর টু নবাবগঞ্জ সেকশন রুটে সরকার নিষিদ্ধ ৫৬টি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার টু নবাবগঞ্জ সেকশন রুটে ৬৫টি সিএনজি অটোরিকশা, নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ টু মিটফোর্ড বাবুবাজার রুটে নিয়মিত প্রায় ৩০টি লেগুনা ও বাবুবাজার ব্রিজের উপর-নিচ থেকে জুরাইন, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ীসহ ১০টি রুটে প্রায় ৩শ’ পরিবহন যান চলাচল করে। অপরদিকে, এ পথে প্রতিদিন পণ্যবাহী সহস্রাধিক ট্রাক-কভার্ডভ্যান ও পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শহর রক্ষা বাঁধে গাবতলী থেকে মিটফোর্ডের বাবুবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ১২ কিঃমিঃ পথ ডিএমপি’র ৮টি থানার অধীনে থাকায় সংশ্লিষ্ট থানা-ফাঁড়ি পুলিশ ও সরকারি দলের কতিপয় প্রভাবশালী নেতার লোকজন এবং চিহ্নিত চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছেন পরিবহন মালিক-চালক ও শ্রমিকরা। তারা বলছেন, রক্ষক হয়ে যারা ভক্ষক হন, তাদের কাছে অভিযোগ করে কোন লাভ নেই। সূত্র আরো জানায়, লালবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন টু মিটফোর্ডের বাবুবাজার রুটে প্রতিদিন প্রায় ৩০টি লেগুনা চলাচল করে। এসব লেগুনা থেকে ৪ থানা ও ফাঁড়ি পুলিশ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং নেতারা মিলে গড়ে প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকার চাঁদা তুলছেন। সোয়ারিঘাটের একটি চায়ের স্টলে বসে কথা হয় লেগুনার মালিক জুলহাস মোল্লার ছেলে সুমনের সাথে। পরিচয় গোপন রেখে চাঁদাবাজির বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ ও সরকারি দলের নেতা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে চাঁদা না দিয়ে কোন পরিবহন এ রুটে ঠিকমত চলাচল করতে পারে না। সুমন বলেন, ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামে লেগুনা থেকে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা হারে মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামে প্রতিদিন ৪ হাজার টাকা হারে মাসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া ইসলামবাগের কথিত যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর মোল্লাও এসব লেগুনা থেকে নিয়মিত মোটা অংকের চাঁদা তোলেন। এদিকে মিটফোর্ডের বাবুবাজার বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নিচে দেখা গেছে, গাবতলী টু বাবুবাজার রুটে চলাচলকারী ব্রাদার্স, যানযাবিল ও প্রত্যয় নামের ৩টি যাত্রীবাহী বাসের কাউন্টার রয়েছে। এসব পরিবহন থেকে লাইনম্যান হিসেবে পুলিশ ও সরকারি দলের এক নেতার নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে চাঁদা তোলেন হিটলার, মেহেদী ও মানিক। তিনটি কাউন্টার থেকে টিআই, পিআই, এসি পেট্রোল ও আনসার প্লাটুন কমান্ডার দীলিপের নামে গড়ে প্রতিদিন ৯শ’ টাকা হারে মাসে ২৭ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া বংশাল ও কোতয়ালী থানাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার দু’ফাঁড়ির নামে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা হারে মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নিচে অবৈধ ফুটপাথের দোকান থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার টাকা হারে মাসে ৯ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন লাইনম্যান মেহেদী। এখানে সরকারি জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা দোকানের মধ্যে রয়েছে, টং দোকান, চায়ের স্টল, রিকশার গ্যারেজ, পাইকারি চাউলের গোডাউন ও ভাংগারি দোকানপাট। আলাপকালে একজন লেগুনা চালক জানান, লেগুনা থেকে কোতয়ালী থানার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা প্রিন্স রবিন গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ও ব্রাদার্স পরিবহন থেকে ৪শ’ টাকা করে চাঁদা আদায় করেন। তার পক্ষে চাঁদা তোলেন ক্যাডার হিটলার। বাবুবাজার থেকে জুরাইনসহ ১০টি রুটে চলাচলরত বিভিন্ন যাত্রী পরিবহন থেকে লালবাগ-কোতয়ালী জোনে কর্মরত ২৭জন ট্রাফিক সার্জেন্টের নামে প্রতি সপ্তাহে মোটা অংকের চাঁদা তোলা হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনে চকবাজার-মিটফোর্ড সড়কসহ অলি-গলিতে কয়েক হাজার হকার বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করে। এসব দোকান থেকে প্রায় ৮০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন লাইনম্যান মেহেদী। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আরো ৬/৭জন লাইনম্যান। ব্রিজের নিচে ফুট দোকান থেকে ৩০ টাকা হারে প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন পরিবহনের লাইনম্যান মানিক।
সূত্র জানায়, ব্রাদার্স পরিবহন থেকে স্থানীয় চিহ্নিত ক্যাডার টাইগার হাবিবের ভাই কথিত আ’লীগ নেতা পিচ্চি ৪শ’ টাকা, যানযাবিল পরিবহন থেকে ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী বিল্লাল শাহ্’র শ্যালক লাবলু ৪শ’ টাকা, বিল্লাল শাহ্’র ভাতিজা মানিক শাহ্ ২ হাজার টাকা, তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক আলাউদ্দিন ব্রাদার্স পরিবহন থেকে ৪শ’ টাকা ও কাউন্সিলরের জন্য ৩টি পরিবহন থেকে লাইনম্যান আব্দুল কাদের প্রতিদিন ২ হাজার টাকা হারে মাসে ৬০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামে লেগুনা থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩শ’ টাকা হারে চাঁদা তোলেন। এছাড়া লালবাগ থানা ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আ’লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী পরিচয় দানকারী কামাল, বিপ্লব, লালু, শাহীন, সামিউল্লাহ্, জাকির এবং রুহুল গড়ে প্রতিদিন ৯ হাজার টাকা করে চাঁদা তোলেন। নবাবগঞ্জ পার্কের বিপরীতে বেড়িবাঁধে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা চোরাই মোবাইল মার্কেটের শতাধিক দোকান থেকে এবং মঙ্গলবার বেড়িবাঁধের হলি-ডে মার্কেটের ৫২৫টি দোকান থেকে গড়ে প্রতিদিন ৯৬ হাজার টাকার চাঁদা তোলেন ওই চক্রের সদস্যরা। নবাবগঞ্জ সেকশন থেকে খোলামোড়া, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার রুটে ও নবাবগঞ্জ সেকশন পুলিশ ফাঁড়ি থেকে গুলিস্তান রুটে ৫ শতাধিক যাত্রী পরিবহন থেকে কামরাঙ্গীরচরের প্রভাবশালী এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর, হাজারিবাগের ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তরিকুল ইসলাম সজিব, আদাবরের ডিএনসিসি’র ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজিব ও তাদের ক্যাডার বাহিনী যাত্রী পরিবহন থেকে গড়ে প্রতিদিন ১ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন। ৫টি রুটে ৩ শতাধিক যাত্রী পরিবহনের মধ্যে নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ থেকে খোলামোড়া রুটে সরকার নিষিদ্ধ ২৫টি থ্রি-হুইলার টেম্পো, ৫৪টি অটোরিকশা, মোহাম্মদপুর রুটে চলাচল নিষিদ্ধ ১৬৪টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার রুটে ৫০টি সিএনজি অটোরিকশা, গাবতলী রুটে চ্যাম্পিয়ন পরিবহন নামে ৬৮টি হিউম্যান হলার, গুলিস্তান রুটে ১২৭টি লেগুনা ও চকবাজার টু সেকশন রুটে ৩৭টি সিএনজি অটোরিকশা নিয়মিত চলাচল করছে। এসব রুটের প্রতি পরিবহন থেকে গড়ে প্রতিদিন ৪৫ হাজার টাকা হারে চাঁদা তোলেন শাহআলম, সেলিম, আলম, রাসেল, নাজিম, টুটুল, মজিবর, জাবেদ ও জামালসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার কাউন্সিলরদের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় ১০জন লাইনম্যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের কয়েকজন মালিক-চালক জানান, দ্রুততম সময়ে পুরান ঢাকার যাত্রীদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যেই তারা শহর রক্ষা বাঁধের এ রুটটি বেছে নেন। কিন্তু দীর্ঘ এ পথে ৮ থানা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সরকারদলীয় কথিত নেতাকর্মীদের হাতে রীতিমতো তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। চাঁদা না দিলে এ পথে তাদের পরিবহন চলাচলে নিয়মিত প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে। এর সাথে আছে গাড়ির কাগজপত্র তল্লাশির নামে সংশ্লিষ্ট থানা-ফাঁড়ি ও ট্রাফিক পুলিশের চরম হয়রানি। শহর রক্ষাবাঁধে নিয়মিত চলাচলকারী দূরপাল্লার ট্রাক ও কভার্ডভ্যান চালক আব্দুল হান্নান ও আমির হোসেন বলেন, তারা দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে শহর রক্ষাবাঁধ দিয়ে পুরান ঢাকার পাইকারি বাণিজ্যিক কেন্দ্র মৌলভীবাজার, চকবাজার, সোয়ারিঘাট, মিটফোর্ড, বাবুবাজার ও ইসলামপুরে যাতায়াত করেন। গাবতলী থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ এ পথে ১৬টি পয়েন্টে সংশ্লিষ্ট থানা ও ফাঁড়ি পুলিশকে পণ্যের প্রকারভেদে সর্বনিম্ম ৫শ’ হতে ১৫/২০ হাজার টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়। অন্যথায় পণ্য ও যানবাহনের কাগজপত্র তল্লাশির নামে বৈধ জিনিসকেও অবৈধ বলে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পরিবহন ব্যবসায়ী ও চালক বলেন, চাঁদাবাজির অত্যাচারে তারা পণ্য ও যাত্রী পরিবহন চালাতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। তাই সড়ক পথে পুলিশ ও শাসক দলের নেতাকর্মীসহ পেশাদার সন্ত্রাসীদের ঝামেলা এড়াতে তারা বাধ্য হয়েই নিয়মিত চাঁদার টাকা তুলে দিচ্ছেন। যার প্রভাব পড়ছে নিত্যপণ্য ও যাত্রীদের ভাড়ার উপর। জানতে চাইলে লালবাগ জোনের এডিসি (ট্রাফিক) মো: আশরাফ হোসেন বলেন, শহর রক্ষাবাঁধে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনে চাঁদাবাজি হয় এমন অভিযোগ এখনো পাইনি। তবে অভিযোগ পেলে বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া কোন পরিবহন ব্যবসায়ী যদি পরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে চাঁদাবাজির শিকার হলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পরামর্শ দিয়ে এডিসি (ট্রাফিক) বলেন, অভিযোগ পেলে ভুক্তভোগীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।