ক্রাইমবার্তা রিপোট: একের পর এক ধর্ষণ। ধর্ষিতার আর্তনাদ। আহাজারি। ধর্ষকদের উল্লাসের নৃত্য। দেশে ধর্ষকের সংখ্যা কত? প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে কতজন ধর্ষক। আপনার পাশেও কী ওত পেতে আছে কোনো ধর্ষক।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৬০২ জন নারী ও শিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ২৫৮ জন নারী ও কন্যা শিশু। ৫৫ জন নারী ও শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়। এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৫ জন, ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে ৬০ জনের ক্ষেত্রে, ২৬ জন নারী শ্লীলতাহানির শিকার হন। এছাড়া যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্ত, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় আক্রমণ থেমে নেই কিছুই। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে ৪৯ জন নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৬ জন নারী, ৩২ জন মেয়ে শিশু ও ১ জনের পরিচয় জানা যায়নি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হন ৬৫ জন নারী ও শিশু। গণধর্ষণের শিকার হন ২৬ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫ জনকে।
মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ছয় বছরে ১৩ হাজার ১৯৪ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হন। এরমধ্যে ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন পর্যায়ক্রমে ৪ হাজার ৭৪৬ জন, ১ হাজার ১৫৩ জন ও ৫৯০ জন। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ৮৯৬ জন নারী ও শিশুকে। শ্লীলতাহানি, যৌন নির্যাতন, উত্ত্যক্ত এবং উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেন যথাক্রমে ১ হাজার ২৬ জন, ৫৯ জন, ৪ হাজার ৩৮ জন এবং ১৪৮ জন নারী ও শিশু।
বিশ্লেষকরা এর জন্য আইনের শাসন ও সুশাসনের অভাবকেই দায়ী করেছেন। তাদের মতে, ধর্ষণের ঘটনা এবং নারীর প্রতি সহিংসতার কথা খুব অল্পসংখ্যকই জানা যায়। দুই একটি ঘটনা আলোচনায় আসলেও অধিকাংশই চাপা পড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা যায় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় ধর্ষণের শিকার ও তাদের পরিবার ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে চায় না। এছাড়া, নেতিবাচক সামাজিক মনোভাবের কারণেও একের পর এক নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, নারী ও শিশুদের ওপর এ ধরনের নির্যাতনের কারণ বলতে গেলে একই কথা বলতে হবে। অপরাধীরা শাস্তি দেখে না। বিচারহীনতার কারণে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে মনে করেন তিনি। সালমা আলী বলেন, উত্ত্যক্তের ঘটনা ঘটলে অনেক সময় দেখা যায় মেয়েরা পরিবার থেকেও সহযোগিতা পায় না। আর আমাদের নারীরা সমাজ থেকে যতটুকু পাওয়ার কথা সেটাও পাচ্ছে না। নারীদের মানুষ না ভেবে ভোগ্যপণ্য মনে করা হয়। এই আইনজীবী আরো বলেন, বখাটেরা ক্ষমতার দিক থেকে এত শক্তিশালী হয়, অনেক সময় পরিবার থেকে অভিযোগ করার সাহস পায় না। এ ধরনের অবস্থার পরিবর্তন করতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। সালমা আলী বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রতিটা বিষয় দুর্বল হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। অপরাধীরা যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে শাস্তির বিধান করলে নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন অনেক কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, যখন দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে, রাজনৈতিক সমস্যা বিরাজ করে তখন আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে না। অপরাধীরা মনে করে দুর্বল নারীরা কিছু করতে পারবে না। তাই নারী ও শিশুরা নির্যাতনের শিকার হয় বেশি। এসব ঘটনার মাধ্যমে নারীদের ভয় দেখানো হয়। যেন তারা পিছিয়ে পড়ে যায়। এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, সারা দেশে প্রতিনিয়তই এসব ঘটনা ঘটছে। কিন্তু প্রচারণা কিংবা মিডিয়ায় সেভাবে জায়গা না পাওয়ায় মানুষ জানতে পায় কম। তবে একটা দুটো ঘটনা যখন খুব বেশি আলোচিত হয় তখন অন্য ঘটনাগুলোও সবার নজরে আসতে থাকে। এলিনা খান বলেন, যতদিন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দ্রুত বিচার ব্যবস্থা কার্যকর করা না হবে ততদিন নারী নির্যাতন এবং বিভিন্নভাবে নারী ও শিশুদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হবে না। আশেপাশের দেশগুলোর তুলনায় নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের দেশে সঠিক ও কার্যকর আইন আছে। কিন্তু সেই আইনগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যখন কেউ নারীর পক্ষে কথা বলতে সামনে এগিয়ে আসেন, তখন তাকে নানাভাবে সমঝোতা করতে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নিহাল করিম বলেন, নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার প্রথম কারণ হচ্ছে সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে প্রথমে পরিবার থেকে এবং পরে সমাজ থেকে নিগৃহীত হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, আমাদের বিচার প্রক্রিয়া এত জটিল সেখানে ধর্ষণের শিকার নারীদের দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হতে হয়। নির্যাতিত হওয়ার পরও তাকেই প্রমাণ করতে হয় সে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। নিহাল করিম বলেন, বাংলাদেশের ধর্ষণ আইন অনুযায়ী সাক্ষী থাকতে হয়। কিন্তু ধর্ষণ করার সময় কেউ নিশ্চয়ই সাক্ষী রেখে ধর্ষণ করবে না। এক্ষেত্রে দেখা যায় যারা এধরনের জঘন্যতম অপরাধ করে তাদের কোনো হয়রানির সম্মুখীন হতে হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে অপরাধীকে প্রমাণ করতে হয় ধর্ষণ সে করেনি। তবে এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করতে হলে সামগ্রিকভাবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। অপরাধী কোনো না কোনো পরিবারে বড় হয়েছে। পরিবার থেকে ছোটবেলায় শিশু বয়সেই মন-মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। বিবেক, মনুষ্যত্ব জাগ্রত করতে হবে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবাইকে আরো আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। মা জ
Check Also
আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইল বাংলাদেশ
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে ভারতকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. …