ষোড়শ সংশোধনীর শুনানিতে প্রধান বিচারপতি
নিম্ন আদালতের পর সুপ্রিম কোর্টও কব্জা করতে চায় সরকার
বুধবার ২৪ মে ২০১৭ |
স্টাফ রিপোর্টার : উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা বলেছেন, নিম্ন আদালত কব্জা করে নিয়েছে সরকার, এখন সুপ্রিম কোর্টকেও কব্জায় নিতে চাচ্ছে। নিম্ন আদালত মানেই আইন মন্ত্রণালয়। এখন উচ্চ আদালতকে পার্লামেন্টের কাছে নিয়ে গেছেন। তাহলে বিচার বিভাগের কী থাকল?
গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চে পঞ্চম দিনের শুনানিতে তিনি এই মন্তব্য করেন। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপদি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
সরকার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন এর্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম। রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
শুনানিতে এটর্নি জেনারেল বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। সাংবিধানিক বিষয় এখানে জড়িত।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এ অবস্থাতে বিচারপতিদের অপসারণ বা ইত্যাদির বিষয়ে কোনো আইন নাই। কাজেই এ বিষয়ে ত্বরিত গতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
এটর্নি জেনারেল বলেন, আমি বলছি, হ্যাঁ নেয়া উচিত। আপনি বলেছেন, এ মাসেই শেষ করা সম্ভব। আমি বলেছি অবশ্যই শেষ করা সম্ভব। পুরো মে মাস পড়ে আছে।
এরপর এটর্নি জেনারেল বলেন, ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে কারা কারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত এর তালিকা চাওয়া হোক।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এগুলো আমরা শুনানির সময় বা রায়ের সময় দেখব।
জবাবে এটর্নি জেনারেল বলেন, সংসদ সদস্যরা ক্রিমিনাল এটি যদি সঠিক না হয়, তাহলে রায় প্রদানকারী ওই বিচারপতিকে অপসারণ করা উচিত। এটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারাইতো নিজ দলের সদস্যদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। কেন পারছেন না? পার্লামেন্ট মেম্বাররা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কেন রেখেছেন? এ প্রশ্নের জবাবে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এটার একটা ইতিহাস আছে। বিভিন্ন দেশে হর্স ট্রেডিং (এমপিদের ভোট কেনা বেচা) হচ্ছে। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকদের ক্ষেত্রে হর্স ট্রেডিং হবে না এটার নিশ্চয়তা কী। প্রধান বিচারপতি বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আরও অনেক প্রশ্ন আছে।
প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের পর এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এটা পলিটিক্যাল ইস্যু। অনেক ইস্যু থাকে। ভাস্কর্যও একটা ইস্যু হয়ে গেছে।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা পলিটিক্যাল ইস্যু নয়। এটার সাথে ওটা মিলাবেন না। নিম্ন আদালতের বিচার পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। নিম্ন আদলতের ৮০ পার্সেন্ট সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে নেই। আপনি বলছেন, বিচার বিভাগ কার্যকর, এক জেলায় ৫ মাস ধরে জজ নেই। বিচার বিভাগ কার্যকর হলো কিভাবে? জবাবে এটর্নি জেনারেল জানান, বিচার বিভাগ যখনই অকার্যকর হয়ে যাবে, তখন দেশে অরাজকতা চলতে থাকবে।
এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, নিম্ন আদালত মানেই আইন মন্ত্রণালয়। এখন উচ্চ আদালতকে পার্লামেন্টের কাছে নিয়ে গেছেন। তাহলে বিচার বিভাগের কী থাকল? এটর্নি জেনারেল তার জবাবে বলেন, বিচার বিভাগ এটা বলতে পারে না। আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি বিচারপতি অপসারণ করতে পারবেন।
এ সময় প্রধান বিচারপতি ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন, এটা আপনি কি বললেন। আপনি তো হাজার বছরে পেছনে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন।
এটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বেশ কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেন প্রধান বিচারপতি। এজলাসে মিডিয়া না থাকলে আরও কিছু প্রশ্ন তাকে করতেন বলেও মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, মিস্টার এটর্নি জেনারেল, আরও কিছু প্রশ্ন ছিল। মিডিয়ার (সংবাদকর্মীদের) উপস্থিতির কারণে বেশ কিছু প্রশ্ন করলাম না। বিভিন্ন দেশের সংবিধান, বিচার বিভাগ ও আইন-আদালত এবং প্রধান বিচারপতির উদাহরণ টেনে আদালত বলেন, ওইসব দেশকে অনুসরণ করা উচিৎ আমাদের।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার শুনানির (লিখিত বক্তব্য) কিছু শব্দের ব্যবহার দেখে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে। কিন্তু মিডিয়ার উপস্থিতির কারণে সেসব প্রশ্ন করতে পারলাম না। কারণ, এসব প্রশ্ন মিডিয়ায় চলে যেতে পারে। কোর্ট উঠলে পরে এসে এই আপত্তিকর শব্দগুলো সংশোধন করবেন। এ সময় এটর্নি জেনারেল বলেন, আপনারা এগুলো নোট করে রাখেন পরে আমরা সংশোধন করে নেব।
পরে মামলার কার্যক্রম আজ বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করেন আপিল বিভাগ।
শুনানি শেষে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা দুটি দরখাস্ত দাখিল করেছি আদালতে। একটি দরখাস্ত দাখিল করেছি হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে একটি জায়গায় বলেছেন, সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। সেটাই আমি দরখাস্ত করেছি আদালতে, যে সংসদ সদস্যদের মধ্যে কারা কারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত এ তালিকা চাওয়া হোক। আদালত বলেছেন, এগুলা আমরা শুনানির সময় বা রায়ের সময় দেখব। আরেকটি দরখাস্ত করেছিলাম দুজন বিচারপতি বাইরে আছেন, তাদেরসহ যাতে শুনানি করা হয়। এ বিষয়টির ওপর আমি আগা-গোড়াই জোর দিচ্ছি। যেহেতু এটা সাংবিধানিক ব্যাপার, সেহেতু আপিল বিভাগের সব কয়জন বিচারপতি যাতে শুনানিতে অংশ নেন, এটা কিন্তু আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, আজও বলছি।
রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় বেশ কয়েক দিন থেকে পূর্ণাঙ্গ সময় ধরেই শুনানি চলছে। শুনানির প্রথম দিকেই আজকে এটর্নি জেনারেল তার লিখিত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছিলেন এবং উপস্থাপন করাকালীন সর্বশেষ সময় যখন সোয়া ১টা বেজে গেছে। নরমালি কোর্ট নেমে যাওয়ার কথা। ওই সময়েই তার লিখিত যুক্তিতর্কের একটি জায়গায় তার একটা মন্তব্যটা এসেছে, সেখানে বলা হয়েছে যে, উনি লিখিত যুক্তিতর্কে তিনি যেটা বলেছেন, সেটা হলো যে, এই যে মন্তব্যগুলো জজ করেছেন, ক্রিমিনাল রেকর্ড সংসদ সদস্যদের। এগুলো যদি প্রমাণিত না হয়, তবে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
এ রকম লিখিত যুক্তিতর্কের প্রশ্নে তখন প্রধান বিচারপতি জানতে চেয়েছেন, এটা কীভাবে সম্ভব। বিচারককে রাষ্ট্রপতি ইচ্ছ করলেই অপসারণ করতে পারেন। এই নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল। তখন এটর্নি জেনারেল বলেছেন, এটা আমার বক্তব্য, আপনারা যদি কিছু বলতে চান এটার ব্যাপারে। তাহলে সেটা বলতে পারেন। মামলার রায়ে সেটা রিফ্লেকশন হবে। এই নিয়ে কথা হচ্ছিল।
মনজিল মোরসেদ বলেন, লিখিত যুক্তিতর্কে এটর্নি জেনারেল অনেক কিছুই বলেছেন, মূলত বিচারকের রায় নিয়ে। আসলে আমরা যখন আপিল করি তখন কিন্তু হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়ের বিরুদ্ধে বলতে পারি যে, সেখানে কোনো আইনগত ভুল হয়েছে, কী ভুল হয়েছে না হয়েছে, যাতে আদালত বারবার আপত্তি উত্থাপন করছিলেন। এটর্নি জেনারেল হিসেবে আপনি এটা বলতে পারেন না।
উনি অনেকগুলো ল্যাংগুয়েজের ব্যাপারে বলেছেন যে, উনি লিখিত যে যুক্তিতর্ক সেটা সংশোধন করেন, যে সমস্ত আপত্তিকর কথা রয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে দিবেন। উনি এটা কমিটমেন্ট করেছেন।
এর আগে গত ৮, ৯ এবং ২১ ও ২২ মে চার কার্যদিবস শুনানি হয়েছে। এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় আপিল শুনানিতে সহায়তার জন্য ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে এমিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ।
১২ আইনজীবী হচ্ছেন-প্রবীণ আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল ওয়াদুদ ভূইয়া ও এম আই ফারুকী।
গত বছর ৫ মে ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের নিষ্পত্তি করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য দুই বিচারপতি হলেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির রায় হওয়ায় ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়।
পুর্নাঙ্গ রায়ে বলা হয় বলতে দ্বিধা নেই ষোড়শ সংশোধনী একটি মেকি আইন (কালারেবল লেজিসলেশন) এবং এটা রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের (নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগ) ক্ষমতার পৃথকীকরণের লঙ্ঘন। সংবিধানের ৯৪ (৪) এবং ১৪৭(২) অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এই দুটি অনুচ্ছেদ সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ। এই সংশোধনী সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের (খ) দফাকে আঘাত করেছে। কেননা সংবিধানের ৭-এর ‘খ’ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মৌলিক স্তম্ভ পরিবর্তন করার কোনো বিধান নেই এ কারণে রুলের সারবত্তা রয়েছে এবং রুলটি সফল। রুল যথাযথ ঘোষনা করা হলো কোন ব্যয় ছাড়া। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আইন ২০১৪ (এ্যক্ট নম্বর ১৩, ২০১৪) মেকি, বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হলো।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ (১৬তম) সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে ৯ জন আইনজীবী এই রিট করেন। তারা হলেন-এডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী, এডভোকেট একলাস উদ্দিন ভুঁইয়া, এডভোকেট ইমরান কাউসার, এডভোকেট মাসুম আলীম, এডভোকেট মো.সারওয়ার আহাদ চৌধুরী, এডভোকেট মাহবুবুল ইসলাম, এডভোকেট নুরুল ইনাম বাবুল, এডভোকেট শাহীন আরা লাইলী, এডভোকেট রিপন বাড়ৈ। রিটে দাবি করা হয়, ষোড়শ সংশোধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্যতম অংশ। তাই ওই সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী।